রাজধানীতে রোদের আলোয় রাস্তা ঝাড়ু

ধূলিদূষণ রোধে মুখ ঢেকে আত্মরক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

আসছে শুষ্ক মৌসুম, রাজধানীতে ক্রমাগত বাড়ছে ধূলি দূষণের মাত্রা। বিড়ম্বনায় পড়ছেন সকল শ্রেণি, পেশার, বয়সের মানুষের। মাত্রাতিরিক্ত ধূলিকণা থেকে রেহাই পেতে মুখে মাস্ক লাগিয়ে আত্মরক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন নগরের বাসিন্দারা।

গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর উত্তরা, রামপুরা, বসুন্ধরা, ফার্মগেট, মিরপুর, কারওয়ান বাজারসহ বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ধূলি দূষণের মূলে রয়েছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন, ভবন নির্মাণ, পুরাতন ভবন ভাঙা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, দিনেরবেলা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীদের পানি না ছিটিয়ে সড়ক ঝাড়ু দেওয়া, নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার না করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধূলিবালি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা রয়েছে। এছাড়াও রাজধানীর চারপাশে গড়ে উঠা অসংখ্য ইটভাটার গনগনে আগুন থেকে বিষাক্ত কার্বন মিশছে বাতাসে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। ফলে শুধু বাতাস নয়, কোনও কোনও এলাকার গাছপালা প্রাণহীন হয়ে মারা যাচ্ছে। সড়কের ধূলিবালির সঙ্গে শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় আশপাশের এলাকার বায়ু বিষবাষ্পে রূপ নেয়। দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন অনুযায়ী কাজের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়া, নিয়মিত পানি ছিটানো ইত্যাদি বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেকক্ষেত্রে মানা হয় না।

জানা গেছে, ঢাকা নগরীর বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ প্রতিদিন দিনের বেলা রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেয়া। ধূলিকণার হাত থেকে রক্ষার জন্য শুধু ঝাড়ু দিয়ে বালু অপসারণ যথেষ্ট নয়। বরং প্রতিবার ঝাড়ু দেওয়ার আগে পানি ছিটানো হলে কিংবা ভোরবেলা জনকোলাহল শূন্য অবস্থায় ঝাড়ু দেওয়া হলে ধূলিকণা বাতাসে আর উড়তে পারে না। কারণ দিনের বেলায় ধূলাবালির প্রকোপ খালি চোখে ধরা পড়ায় প্রায় এলাকায় নাক মুখ না ঢেকে চলাচল করা খুবই ভয়াবহ। ফলে যানবাহনে চলতে গেলে সহজেই এসব ক্ষতিকর ধূলিকণা চোখে মুখে ঢুকছে। নগরের পথে–প্রান্তরে ধূলিকণা অস্বাভাবিক হারে শ্বাস গ্রহণের কারণে অনেক মানুষ যক্ষ্মা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, চোখের নানারকম রোগ, চর্মরোগসহ অসংখ্য জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে এরই মধ্যে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

ঢাকার বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ, সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি, মেরামতসহ অন্যান্য কাজে তৈরি হওয়া ধুলা নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ থাকলেও তা খরচ করা হয় সামান্য। মাঝে মাঝে নামকাওয়াস্তে পানি ছিটানো হয়। ধুলা-বালু নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয় না। দুই সিটি করপোরেশন রাস্তায় ঝাড়ু দেওয়া ও পানি ছিটানোর কাজও ঠিকমতো করে না।

ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, দিনের বেলায় রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার নিয়ম নেই। এরপরও কোনো পরিচ্ছন্নকর্মীদের যদি দিনের বেলায় ঝাড়ু দিতে দেখেন তাহলে সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাকে জানাবেন। ঢাকার কিছু এলাকায় সকালে অফিস যাওয়ার সময় বায়ুদূষণ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সেসব এলাকায় নিয়মিত গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে রাস্তায় পানি ছিটানো হলে কিছুক্ষণ পর তা শুকে যায়। আবার ব্যস্ততম এলাকায় যখন-তখন গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা বলছেন, যখন-তখন রাস্তায় পানি ছিটালে যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হবে নগরবাসীকে। খোলামেলা পরিবেশ ও নির্মল বাতাসে থাকার কথা বললেও ঢাকায় এমন পরিবেশ পাওয়া খুবই মুশকিল। ধুলা-বালু রোধে প্রতিদিন প্রায় ১৪টি গাড়ির দিয়ে ৫০ কিলোমিটার সড়কে পানি ছিটানো কার্যক্রম শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেও বেশ কয়েকটি গাড়ি পানি ছিটানোর কাজে ব্যবহার হয়। তবে এই শহরের জন্য এটি পর্যাপ্ত গাড়ি নয়।

এদিকে ধুলা রোধে দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট নন নাগরিকরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পানির নিজস্ব কোনো উৎস নেই। ওয়াসার পাম্প থেকে পানি নিয়ে বিভিন্ন সড়কে ছিটায় ডিএসসিসির প্রায় ১৪টি গাড়ি। কিন্তু এ বছর ওয়াসা পানি না দেয়ায় সড়কে পানি ছিটানো যাচ্ছে না। ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) আবু নাসের আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ধুলা-বালু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের বিষয়টির সঠিক তথ্য তার কাছে নেই। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ধূলিবালির কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে। উদ্বেগের মাত্রা বেশি হলে প্রয়োজনে সাময়িকভাবে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এই ভয়াবহতাকে স্বীকার করে নিয়ে সামনের দিনগুলোতে কীভাবে মোকাবিলা করব, এটা গুরুত্বপূর্ণ।

শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ হাঁপানি রোগী। চিকিৎসক কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর বলছেন, হাঁপানি বংশগত হতে পারে আবার পরিবেশগত কারণেও হতে পারে। তবে ইদানীং পরিবেশগত কারণটিই বেশি দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক যে কারো হাঁপানি হতে পারে।

ঢাকা বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় এক থেকে পাঁচের মধ্যে ওঠানামা করছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য পদার্থের মধ্যে ভাসমান ধূলিকণাও বায়ুর একটি অন্যতম উপাদান। ধূলিকণার আকার ১০ মাইক্রোগ্রামের (পিএম-১০) বেশি হলে তা বায়ুতে ভেসে বেড়াতে পারে না। ছোট আকারের ধূলিকণাই (পিএম ২.৫) বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং দূষণ ঘটায়। বাতাসের গুণগত মাননির্ভর করে বায়ুতে ভাসমান এই সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে। পিএম ২.৫, পিএম ১০ ছাড়াও সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও গ্রাউন্ড লেভেল ওজোনে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বিবেচনা করে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) তৈরি হয়। একিউআই মান যত বাড়তে থাকে, বায়ুমান তত ঝুঁকিপূর্ণ হয়। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এরকম ২০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ধূলিকণা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়, তার বেশি হলেই ধূলিদূষণ হয়। নগরীতে শুষ্ক মৌসুমে একিউআই মান গড়ে প্রায় ৩০০ মাইক্রোগ্রামের বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই পিএম-২.৫ হলো একিউআই-এর জন্য দায়ী দূষণকারী। সাধারণত পিএম ১০ আকারের ধূলিকণা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়, পিএম ২.৫ চক্ষু ও চর্মরোগের কারণ, পিএম ১.০-এর নিচের আকারের ধূলিকণা মানবদেহে টিউমার সৃষ্টির কারণ এবং পিএম ০.১ আকারের ধূলিকণা হৃদরোগের কারণ। পিএম ২.৫ ব্যাসের কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সরাসরি সংস্পর্শ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া চুল পড়া, মাথার ত্বকে খুশকিসহ নানান জটিলতা দেখা দেয়।