ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

একত্রিত হচ্ছেন আন্তঃক্যাডার কর্মকর্তারা

দশ বছরে ১৩ বার পদোন্নতিতে বৈষম্য

দশ বছরে ১৩ বার পদোন্নতিতে বৈষম্য

সারা দেশে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও প্রশাসনিক চালিকাশক্তির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এতে দিনে দিনে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তবে চাকরিতে যোগদানের পরই পদোন্নতির ইস্যুটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, প্রশাসনে গত কয়েক বছর ধরে পর্যাপ্ত পদ ছাড়াই কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে ২৬ ক্যাডারের মধ্যে ‘প্রশাসন ক্যাডার’ ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে বৈষম্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বৃহত্তর কৃষি ক্যাডারে ১১ বছরে মাত্র ৪৬ কর্মকর্তা উপসচিব হতে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন, যার শতকরা হার ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

আন্তঃক্যাডারের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বছরের পর বছর প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্য চলে আসছে। ক্যাডারে ভিন্নতা থাকলেও চাকরির ১০ বছর পূর্ণ হলে যে কোনো ক্যাডারের কর্মচারী উপসচিব পুলভুক্ত হতে পারেন। পুলভুক্তের পর তাদের প্রাথমিক যোগদানকৃত ক্যাডার পরিচিতি থাকে না। সবাই একই ক্যাডারভুক্ত গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন। প্রকৌশলী, তথ্য, কাস্টমস, স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিক্ষাসহ ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপসচিবের তদূর্ধ্ব যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিবের পদোন্নতির সময় কোটার ফাঁদে ফেলে বঞ্চিত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরে চলা আন্তঃক্যাডার বৈষম্য চলছে। সরকারের উপ-সচিব পদ হতে যুগ্ম সচিব পদে গত ১১ বছরে ১৫ বার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে আন্তঃক্যাডারদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১৩ বার বৈষম্য করা হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে উপসচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে ২২১ জন যুগ্ম সচিব করে দুটি প্রজ্ঞাপন দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানেও বৈষম্য করা হয়েছে। সেজন্য শিগগিরই আন্তঃক্যাডার কর্মকর্তারা একত্রিত হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবিহিত করবেন বলে জানা গেছে।

গত ১১ বছরের পদোন্নতির পরিসংখ্যান বলেছে, ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি উপসচিব থেকে ২৬৪ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। যেখানে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪৩ জন এবং অন্যসব ক্যাডারের ২১ জন পদোন্নতি পান, যা আন্তঃক্যাডারের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মাত্র ৮ শতাংশ। একই ধারা অব্যাহত ছিল ২০১৩ সালের ১৮ জুলাইও। ওই বছর উপসচিব হতে ২৮৬ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সেখানেও আন্তঃক্যাডারের ৪০ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পান, যা ১২ শতাংশ। একই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ৭০ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এখানেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ৭০ জনের মধ্যে ৬১ জনই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা আর আন্তঃক্যাডারের ৯ জন কর্মকর্তা ছিলেন, যা আন্তঃক্যাডারের ১৩ শতাংশ পদোন্নতি পান। ২০১৫ সালের ৬ মার্চে ২৮৮ জন যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পান। যেখানে প্রশাসন ক্যাডার হতে ২২৩ জন এবং আন্তঃক্যাডার হতে ৬৫ জন পদোন্নতি পান, যা আন্তঃক্যাডারের যা ২২ শতাংশ। তবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ২০১৬ সালটি একটু ব্যতিক্রম ছিল। ওই বছরের ১৫ মে উপসচিব হতে ৬৯ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের ৪৮ জন এবং আন্তঃক্যাডারের ২১ জন। এখানে আন্তঃক্যাডারের ৩০ শতাংশ কর্মকর্তা পদোন্নতি পান।

পদোন্নতিতে কোটার বিধান অনুসরণ করা হয়েছে। তবে একই বছরের ২৭ নভেম্বর ফের ১৮৬ কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পান, যার মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ১৫৮ জন এবং আন্তঃক্যাডারের ২৮ কর্মকর্তা ছিলেন। আন্তঃক্যাডারের মাত্র ১৫ শতাংশ পদোন্নতি পান। ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ১৮৯ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এখানে প্রশাসন ক্যাডারের ১৬৮ জন এবং অন্য সকল ক্যাডারের ২১ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পান। পদোন্নতিতে আন্তঃক্যাডারের ১১ শতাংশ।

২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ১৪৯ জন যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সেখানেও প্রশাসন ক্যাডারের ১৩২ জন এবং আন্তঃক্যাডারের ১৭ জন, যা আন্তঃক্যাডারের ১১ শতাংশ। ২০১৯ সালের ১৬ জুন উপসচিব হতে ১৩৬ জন যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই বছর প্রশাসন ক্যাডারের ৯৯ জন এবং অন্য সব ক্যাডারের ৩৭ জন। পদোন্নতিতে আন্তঃক্যাডার ২৭ শতাংশ। ঠিক ১ বছর পর ২০২০ সালের ৫ জুন উপসচিব হতে ১১৭ জন যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রশাসন ক্যাডারের ৭৮ জন এবং অন্য সকল ক্যাডারের ৩৯ জন। পদোন্নতিতে অন্য সকল ক্যাডারের ৩৩ শতাংশ।

এই বছরে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের চেয়ে অন্য সকল ক্যাডারের কর্মকর্তারা বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। একই বছরের ২ সেপ্টেম্বর ১৪২ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। যেখানে প্রশাসন ক্যাডারের ১৩৩ জন এবং অন্য সকল ক্যাডারের মাত্র ৯ জন পদোন্নতি পান। প্রশাসনে ১১ বছরের ইতিহাসে আন্তঃক্যাডারের মাত্র ৬ শতাংশ পদোন্নতি পেয়েছেন।

২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর উপসচিব হতে ২১৩ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। প্রশাসন ক্যাডার ১৮১ জন এবং অন্যান্য ক্যাডার ৩২ জন। ২০২২ সালের ২৯ জুন ৭৮ জন পদোন্নতি পান। প্রশাসন ক্যাডারের ৬২ জন এবং আন্তঃক্যাডার ১৬ জন। একই বছরের ২ নভেম্বর উপসচিব হতে ১৭৫ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এতে প্রশাসন ক্যাডার হতে ১৪৫ এবং আন্তঃক্যাডার হতে ৩০ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। আন্তঃক্যাডারের ১৭ শতাংশ। সর্বশেষ চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর উপসচিব হতে ২২১ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৭ জন এবং আন্তঃক্যাডারের ২৪ জন কর্মকর্তা ছিলেন। পদোন্নতিতে আন্তঃক্যাডারের মাত্র ১১ শতাংশ। এভাবে বছরের পর বছর বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে পদোন্নতির ক্ষেত্রে আন্তঃক্যাডারের কর্মকর্তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা, ২০০২’ বলা হয়েছে, যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডারের ৩০ শতাংশ বিবেচনায় নিতে হবে। উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির জন্য প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ১৫ বছরের মোট চাকরিসহ ফিডার পদে ৫ বছর এবং অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ২০ বছরের মোট চাকরিসহ ফিডার পদে ৩ বছরের চাকরি প্রয়োজন। যখনই কোনো কর্মকর্তা ২০০২ সালের বিধিমালা অনুসারে উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হবেন, তাহা যে কোনো ক্যাডারের হতে পারে, তিনি তখন একজন পরিপূর্ণ উপসচিব। সেখানে তার পূর্বের ক্যাডার পরিচয় বিলুপ্ত হবে।

এ বিষয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রশাসনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বরাবরই বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। কারণ পদোন্নতির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য করছেন। অথচ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে পছন্দের ক্রমানুসারে বিভিন্ন ক্যাডারে প্রার্থীরা যোগদান করেন। তবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য ক্যাডারে সকল পদের বিপরীতে উপযুক্ত কর্মকর্তা না পাওয়ায় পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হয় না।

প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চনায় বাড়ছে ক্ষোভ এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব (এপিডি অনুবিভাগ) আব্দুস সবুর মন্ডল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘উপসচিব হতে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য হচ্ছে- এমন তথ্য ঠিক নয়। পদোন্নতি হয় ভ্যাকেন্সির (শূন্যপদ) ওপর। ক্যাডার পদেও পদোন্নতির সোপান রয়েছে, সেই অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়া হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘উপসচিব হতে প্রশাসন ক্যাডারের ১০০ কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেলে, আন্তঃক্যাডারের ২৫ কর্মকর্তা পদোন্নতি পাবেন।’

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, প্রশাসনে ক্যাডার বৈষম্য থাকা উচিত নয়। দক্ষতারভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া উচিত। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে, যা আগে কখনই দেখা যায়নি। তিনি আরো বলেন, জনপ্রশাসনের আদর্শ কাঠামো তো ভাঙছেই, উল্টো এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কারণ, পদোন্নতি পেলেও অধিকাংশ কর্মকর্তা পদোন্নতি পাওয়া পদে চাকরি করতে পারছেন না। কাজ করতে হচ্ছে এক বা ক্ষেত্রবিশেষে দুই স্তর নিচের পদে। এতে ব্যক্তি লাভবান হলেও পুরো জনপ্রশাসনের ক্ষতি হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, সর্বশেষ চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর উপসচিব হতে ২২১ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের পদ ৫০২টি। নতুন পদোন্নতির পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৪৬ জনে। তবে পদ না থাকায় পদোন্নতি পাওয়া অধিকাংশ কর্মকর্তাকে আগের পদেই (ইন সিটু) কাজ করতে হবে অথবা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হয়ে থাকতে হবে। বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডার পদে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন হয়নি। সেজন্য রীতিমতো পেশাবদলের ঘটনা ঘটছে। কারণ একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা যেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। সেই সুযোগ-সুবিধা একজন স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা পাচ্ছেন না। একজন পুলিশ ক্যাডারের পুলিশ অফিসার যে সুযোগ-সুবিধাগুলো পাচ্ছেন, সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ওই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। ফলে ৩৮তম বিসিএসের ক্যাডার পদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই তাদের পেশার সঙ্গে জড়িত ক্যাডার পদ ছেড়ে পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ এবং অনেকেই সাধারণ ক্যাডার পদে যোগ দিয়েছেন। মোট ২ হাজার ২০৪ জনের মধ্যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয় ২৫ জন। এই ২৫ জনের সাতজন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ১৩ জন বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আবার এই ১৩ জনের ১০ জনই বুয়েটের শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত