ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাম্প্রতিক ভাবনা

দুর্গাপূজা হোক প্রাণের উৎসব জাগ্রত হোক সম্প্রীতির বন্ধন

দুর্গাপূজা হোক প্রাণের উৎসব জাগ্রত হোক সম্প্রীতির বন্ধন

আজ থেকে শুরু হলো দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। শেষ হবে আগামী মঙ্গলবার বিজয়া দশমীর মধ্যদিয়ে। শরতে প্রকৃতির রং সাদা। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। আর প্রকৃতিতে কাশফুলের ঢেউ। আর এই কারণেই সম্ভাবত দুর্গাপূজাকে শারদীয় দুর্গোৎসব বলা হয়। দুর্গোৎসব সবার উৎসব। সব বাঙালির উৎসব। আর এই বাঙালির চেতনায় মিশে আছে অসাম্প্রদায়িকতা। আর সে কারণে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকে ছিল মাত্র ২৩ বছর। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান ক্রমশ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ জন্ম লাভ করে। ধর্ম নিরপেক্ষতা আমাদের দেশের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি। তবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করার পর মুক্তিযুদ্ধের ভাবধারার বিরোধী শক্তি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় একাত্তরের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। অথচ ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান; আমরা সবাই বাঙালি’ এটাই আমাদের চেতনা। ধর্মের সাথে জাতীয়তার কোনো বিরোধ নেই। ধর্মের সাথে উৎসবের কোনো বিরোধ নেই। ঈদের সেমাই, পূজার নাড়ু সবার ঘরেই পৌঁছে যায়। আর ইসলাম ধর্মেও অন্য সবার ধর্ম পালন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

এই পূজাকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরে ঘরে এখন আনন্দ। বিশেষ করে শিশুরা উৎসবে মেতে উঠছে। সকল বয়সি মানুষ দেবী দর্শন করতে মন্দিরে মন্দিরে যাচ্ছেন। হিন্দু পরিবার নতুন পোশাক কিনছে, উন্নতমানের খাবার তৈরি করছে, আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করছে। তারা একে অপরের বাড়িতে যাচ্ছেন। গুরুজনদের আর্শিবাদ নিচ্ছেন। মূলত আজ থেকে আগামী পাঁচ দিন চলবে এই দুর্গোৎসব। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব। উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা তারা। এই দেশে কেবল হিন্দুরাই নয়, তাদের এই প্রাণের উৎসবে যোগ দিচ্ছেন অন্য ধর্মের মানুষও। অন্য ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে দুর্গোৎসব হয়ে উঠবে প্রাণবন্ধ। সম্প্রীতির বন্ধন আরো দৃঢ় হবে- এমনটাই প্রতাশা এদেশের মানবতাবাদী মানুষদের। আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিরোধ কিংবা পরস্পরের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকলেও হিন্দু, মুসলমান কিংবা অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বৈরীতা নেই। সব ধর্মের মানুষ ধর্মীয় উৎসব পালনের সময় কোনো প্রকার জাতপাতের বিচার করে না। আনন্দকে তারা ভাগাভাগি করে নেয়। এটাই আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতি। পূজায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িতে অন্য ধর্মের মানুষও যাচ্ছেন। তারা আপ্যায়িত হচ্ছেন। পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও কুশলাদি বিনিময় করছেন। এই দেশ সবার। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আলবদর, আলশামসের মতো কেবল মাত্র গুটিকয়েক লোক ছাড়া এ দেশের সব শ্রেণির মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সবাই পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে যে কোনো সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সবাই একসাথে আওয়াজ তোলায় দেশ আজ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। তাই বলা যেতে পারে- কেবল ভিন্ন মতে রাজনীতি ছাড়া এদেশের জনসাধারণ এক ও অভিন্ন। আর সে কারণে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই মূলমন্ত্র আজ আমরা ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারছি। শহর পেরিয়ে গ্রামীণ জীবনেও দুর্গোৎসবের ঢেউ লেগেছে। নগর জীবনের দুর্গাপূজা আর গ্রামীণ জীবনের দুর্গাপূজার মধ্যে অনেকখানি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ জীবনে দুর্গোৎসবের যে ‘আবেদন’ নগর জীবনের দুর্গোৎসবের সেই ‘আবেদন’ নেই বলে অনেকেই মনে করেন। তবে নগর জীবনে হোক, আর গ্রামীণ জীবনেই হোক; দুর্গোৎসব কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সর্বজনীন এই উৎসব পেয়েছে বহুমাত্রিকতা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর টানা দায়িত্ব পালন করে আসছে। আর সেই কারণে দিন দিন পূজামণ্ডপের সংখ্যা বাড়ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ‘ভয়শূন্যচিত্তে দুর্গোৎসব উদযাপন করছেন। বাংলাদেশ ও ভারত বর্ষের বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় এই সময়ে দুর্গোৎসবে মেতে উঠে।

বিএনপি-জামায়াত দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করে। দীর্ঘদিন এই ধারা অব্যাহত ছিল। তবে ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে আবার দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্ম নিরপেক্ষতাকে উপজীব্য করে তোলে। তবে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই ধারা বিচ্যুৎ হয়। তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে পালন করা সুযোগ পাচ্ছে।

হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির বিজয়ে মা দুর্গার মর্ত্যে আবির্ভাব। আবহমান বাংলায় সব ধর্মের মানুষ সমঅধিকার নিয়ে বাস করায় শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু হিন্দুদের একার উৎসব নয়, পরিণত হয়েছে সর্বজনীন উৎসবে। মুসলমানদের ঈদ হোক কিংবা হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা- কোনো উৎসবই এখন আর কোনো ধর্মের মানুষের একক সত্তা নয়। এটা এখন রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে গেছে। কেন না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতি ধর্মের প্রধান উৎসবে ওই ধর্মের লোকজনদের জন্য গণভবনে সংবর্ধনার আয়োজন করে থাকেন। যে কোন ধর্মের উৎসবে অন্য ধর্মের লোকজনও আনন্দ-উদ্দীপনায় শরীক হয়। পরস্পরকে আমন্ত্রণ জানানো এখন রীতিনীতির পর্যায়ে পড়ে গেছে। পরস্পরের উৎসবে শুভেচ্ছা জানানো কিংবা আপ্যায়নের বিষয়টিকে অনেক গুরুত্বে চোখে দেখা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও পূজামণ্ডপ পরিদশন করছেন। তারা সবার সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছেন। পূজার সময় সরকারের তরফ থেকে আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে। এসব কারণে বাংলাদেশ আজ সব ধর্মের মানুষের নিরাপদ আবাস ভূমি। প্রতিটি পূজামণ্ডপে অন্য ধর্মের মানুষও ভীড় করছেন। বিশেষ করে শিশুদের আনাগোনায় পূজামণ্ডপগুলো হয়ে উঠছে আরো প্রাণবন্ত, আরো উৎসবমুখর। দুর্গোৎসব এখন বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। কেন না, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এই শারদীয় উৎসবে। আর সে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণীতে হিন্দু সম্প্রদায়কে শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা জানানোর মধ্যদিয়ে এই উৎসবকে আরো মহিমান্তিত করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বন্ধন অটুট থাক অনন্তকাল। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির সব বিবেকবান মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাক যুগ থেকে যুগান্তরে- শারদীয় দুর্গোৎসবে এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত