ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আন্দোলনের নামে নাশকতা করলে ছাড় নয় : প্রধানমন্ত্রী

* অগ্নিসন্ত্রাসের মামলা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে * ১৫ তলাবিশিষ্ট বার কাউন্সিল ভবন উদ্বোধন * অন্যায়কারী যেন সাজা পায়
আন্দোলনের নামে নাশকতা করলে ছাড় নয় : প্রধানমন্ত্রী

আন্দোলনের নামে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করলে বিএনপি-জামায়াত চক্রকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতসহ আরো অনেকেই মাঠে নামতে চায়। আন্দোলন করুক এই ব্যাপারে আমাদের কোনো কথা নেই। কিন্তু তারা যদি আবার ওইরকম অগ্নিসন্ত্রাস বা কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ করে বা কোনো ধরনের দুর্বৃত্ত পরায়ণতায় জড়ায় আমরা কিন্তু ছাড় দেব না। এটাই বাস্তবতা।

গতকাল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ আয়োজিত আইনজীবী মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ঢাকার হাইকোর্ট সংলগ্ন এলাকায় নবনির্মিত অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ১৫ তলাবিশিষ্ট বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন উদ্ধোধন করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বিএনপি আমাদের কত নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। চোখ তুলে নিয়েছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তাদের হাঁড় গুঁড়োগুঁড়ো করে হত্যা করেছে। এরপর আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্ট করল ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাস করে। তারা সে সময় ২৯ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। ৩ হাজার ২২৫ জন লোককে অগ্নিদগ্ধ করেছে, ৫০০ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ৩৮৮টি গাড়ি, সাধারণ মানুষের প্রাইভেট কার, সিএনজি, ২৯টি রেল, ৯টি লঞ্চে অগ্নিসংযোগ করেছে। চলমান প্রাইভেট গাড়ি, বাস ও ট্রাকে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যা করেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, এই অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে যারা জড়িত জেলায় জেলায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং মামলা চলমান রয়েছে সে মামলাগুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। আইনজীবী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে এটা আমার অনুরোধ। কারণ এরা এত অন্যায় করেছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই তো সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, তাহলে তাদের শাস্তি হবে না কেন? কেন তাদের বিচার কাজ দ্রুত হবে না। সে ব্যাপারে আপনাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে এরা বাড়বে। অবশ্যই তাদের বিচার বাংলাদেশে হতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগুনসন্ত্রাসীদের মামলা কেবল চালালেই হবে না তারা যেন যথাযথ শাস্তি পায় তার ব্যবস্থা আপনাদের করতে হবে। এটা আইনজীবীদের কাছে আমার নিজের দাবি। বিচারহীনতা যেন এদেশে আর না চলে। ন্যায়বিচার যেন মানুষ পায়। স্বজন হারিয়ে বেঁচে থাকা যে কি কষ্টের যারা আমরা আপনজন হারিয়েছি তারা তা বুঝি। জাতির পিতা এবং ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার বিচার করতে পারায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া আদায় করছি। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত। জিয়াউর রহমান এর বেনিফিসিয়ারি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই মানুষের অধিকার সুরক্ষিত থাকুক। ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। বিচার পেতে আমাদের মতো যেন ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে না হয়। সেভাবে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার আমি আহ্বান জানাই। ৭৫ থেকে ৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই ২৯ বছরে এ দেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যারা ক্ষমতায় ছিল তারা নিজেদের ভাগ্য গড়তেই ব্যস্ত ছিল, দেশের জন্য নয়। কিন্তু একমাত্র আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে তখনই দেশের মানুষের ভাগ্য ফিরতে শুরু করেছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে যেটা আগে করেছিল। সেটা যেন আর করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমার একটা অনুরোধ আপনাদের কাছে, কোথাও যেন এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না থাকে। যে যা পারেন তাই উৎপাদন করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। এখানে স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। আমি যার জন্য বলেছি ধর্ম যার যার উৎসব সবার। কাজেই এ ক্ষেত্রেও কেউ কারো ধর্মের ওপর আঘাত হানবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, তাতে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। মানুষের কল্যাণে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

বিচার বিভাগ এবং আইনজীবীদের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে সরকারপ্রধান বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যেন কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা না হয়, সেজন্য স্মার্ট জুডিশিয়ারি করার উদ্যোগ হিসেবে ই-জুডিশিয়ারি চালু করেছি। জেলে ভার্চুয়াল কোর্ট বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আইনগুলো সংশোধন করে যুগোপযোগী করে দেয়া হয়েছে। আগামীতে জেলায় জেলায় আইনজীবীদের জন্য বিশেষ প্লটের ব্যবস্থা করা হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার একটি অনুরোধ থাকবে আপনারা সর্বজনীন পেনশন স্কিম গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি আপনাদের কল্যাণ ফান্ড, যেটা জাতির পিতা করে দিয়েছেন, আমিও বিভিন্ন সময় দিয়েছি, সেটাতে আমি আরো ৩০ কোটি টাকা দেব। আপনারাও সাধারণ আইনজীবীরা এতে কন্ট্রিবিউট করবেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যত বেশি স্বাবলম্বী হবো, ততবেশি আইনজীবী থেকে শুরু করে সবার জন্য সুযোগ অবারিত করে দিতে পারব। আসুন সবাই মিলে সেই বাংলাদেশ গঠনে কাজ করি। আপনারা মানুষের পাশে থাকবেন। যেখানেই অন্যায় দেখবেন, অন্যায়কারী যেন সাজা পায় সেজন্য কাজ করবেন। একেবারে নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত দেশের সবাই যেন ন্যায়বিচার ও উন্নত জীবন পায়, দারিদ্র্যমুক্ত হয় সেটাই আমাদের প্রচেষ্টা। আমাদের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে বিএনপি সরকারের আমলে যেখানে ৪১ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যের হার, আমরা তা কমিয়ে ১৮ দশমিক সাত ভাগে নামিয়ে এনেছি। হতদরিদ্র যেখানে ২৫ দশমিক পাঁচ ভাগ ছিল, সেটা কমিয়ে আমরা মাত্র পাঁচ ভাগে নামিয়ে এনেছি। ইনশাআল্লাহ কেউ এ দেশে হতদরিদ্র, ভূমিহীন, গৃহহীন, ঠিকানাবিহীন থাকবে না। সেটাই আমাদের লক্ষ্য।

তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে আমাকে আগেই গ্রেপ্তার করেছে। যখন গ্রেপ্তার করেছে, আপনারা আইনজীবীরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রতিনিয়ত একটার পর একটা মামলা দিয়েছে। আমাকে হয়রানি করেছে। আমি কিন্তু টলিনি। নিম্ন আদালতের পাশাপাশি উচ্চ আদালতের আইনজীবীরাও পাশে ছিলেন। এজন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

জাতির পিতার হাত ধরেই বাংলাদেশে বিচার কাঠামোর গোড়াপত্তন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার ৯ মাসের মাথায় কেবল একটি সংবিধানই আমাদের দেননি ৭২ সালে তিনি ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনার অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২’ জারি করেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করে তাদের জন্য ৪৪ শতাংশ জমি বরাদ্দ করেন এবং ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে আইনজীবীদের কল্যাণ ফান্ড গঠন করে দেন। তিনিই পাকিস্তান আমলের আইন পরিবর্তন করে নারীদের বিচার বিভাগে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করে যান। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তার নেতৃত্বাধীন সরকার ’৯৬ পরবর্তিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে প্রথম উচ্চ আদালতে নারীদের বিচারক হওয়ার ব্যবস্থা এবং দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পদক্ষেপ জাতির পিতাই শুরু করে যান। সমুদ্র সীমা নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্র প্রস্তুতসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও শুরু করেছিলেন।

’৭৫-এর বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে জিয়াউর রহমানের সহায়তায় বেঈমান মোশতাক ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু টিকতে পারেনি। আসল চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসেন জিয়া। ক্ষমতা দখল করেন। একাধারে সেনাপ্রধান আবার নিজেকে রাষ্ট্রপতির ঘোষণা করেন। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে জাতির পিতা হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে। নির্বাচন প্রক্রিয়া ধ্বংস করে নিজেই দল গঠন করে কারচুপি করে দুই তৃতীয়াংশ মেজরিটি দিয়ে সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করেন। খুনিদের জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসায়। বাবা-মা হত্যার বিচার চাইতে পারবেন না, খুনিরা ক্ষমতায়, এরকম একটি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ’৮১ সালে একরকম জোর করে দেশে ফিরে আসার কথা স্মরণ করেন তিনি। বলেন, সে সময় আমি দেশে ফিরে দেখি ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে কিছু লোকের ভাগ্য উন্নয়ন করেছে। কিন্তু জনগণের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি। আমি গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়াই। মানুষের কষ্ট দুর্দশা দেখি। পরে ২১ বছর পর আমরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করি। বিচার বিভাগের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিই।

অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধুর আইনি দর্শন’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় এবং পরে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিল্পিরা সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন।

আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে আরো বক্তৃতা করেন, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এটর্নি জেনারেল ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এএম আমিন উদ্দিন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক কাজী মো. নজীবুল্লাহ হিরু ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশেনের মেয়র ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপস প্রমুখ।

অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বহুতল নবনির্মিত ১৫ তলা বার কাউন্সিল ভবনটি তৈরিতে ১৩৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আইন ও বিচার বিভাগের তত্ত্বাবধানে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের নকশায় ভবনটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত অফিস স্পেস, মিটিং রুম, দুটি কনফারেন্স রুম, রেকর্ড রুম, স্টোর রুম, ওয়েটিং এরিয়া, ক্যাফেটেরিয়া, ডে-কেয়ার সেন্টার, এক্সিবিশন স্পেস, রিসিপশন, রেজিস্ট্রেশন রুম, ব্যাংক, অ্যাকাউন্টস সেকশন, আইটি সেকশন ইত্যাদি। আইনজীবীদের জন্য প্রশিক্ষণ কক্ষ, পাঁচটি ট্রাইব্যুনাল কক্ষ, সুপরিসর মাল্টিপারপাস হল, নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক নামাজ কক্ষ রয়েছে। এছাড়া টিভি লাউঞ্জ, কিচেন ও ডাইনিং হলসহ শতাধিক আইনজীবীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভবনটিতে চারটি লিফট, ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং পুরুষ-নারী-প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক শৌচাগার রয়েছে। প্রকল্পে আরবরিকালচারের মাধ্যমে ল্যান্ডস্কেপিং করা হয়েছে। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সাবস্টেশন ও জেনারেটরের মাধ্যমে পৃথক বৈদ্যুতিক লাইন সংযুক্ত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত