ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস আজ

বাড়ছে নৈরাজ্য মরছে মানুষ

সড়ক নিরাপদের জন্য আরেকটি আইন দরকার : ইলিয়াস কাঞ্চন
বাড়ছে নৈরাজ্য মরছে মানুষ

চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ কার্যকর করা হয়েছে। তবে সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে আইনটি যথেষ্ট নয়। কারণ, আইনে চালক, পথচারী ও জরিমানা প্রধান্য পেলেও সড়ক নিরাপদের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। সেজন্য আলাদা আরেকটি ‘সড়ক নিরাপদ আইন’ তৈরি করা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, নিরাপদ সড়কের জন্য ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দেশকাঁপানো আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে- এমন আশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি। দুর্ঘটনা রোধে সরকার নানা আশ্বাস দিলেও সড়কে বিশৃঙ্খলা আগের মতোই রয়েছে। নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে- নজরদারির অভাব ও আইনের বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি। আর সাম্প্রতিক সময়ে ভাড়ায় চালিত (রাইড শেয়ারিং) ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের মোটরসাইকেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি সড়কে প্রাণহানি বেড়ে গেছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- বছর বছর মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা বৃদ্ধি, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ছোট ও ধীরগতির যানবাহনের চলাচল দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও আজকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আইন মেনে সড়কে চলি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’। দিবসটি উপলক্ষ্যে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে ট্রাফিক আইন মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষ্যে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বাধীন সংগঠন নিসচাও (নিরাপদ সড়ক চাই) বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন হয় দেশে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ করা হয়। এরপর সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ ঘোষণা করে সরকার।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের বেহাল দশায় কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাইপাইল থেকে আউলিয়া ধউর পর্যন্ত মহাসড়ক উঁচু নিচু থাকায় যানবাহন চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে চালকদের। বাইপাল ও ধউর ছাড়াও সারাদেশে অলিগলি-মহাসড়কের বেহাল দশা। এ বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই এর চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ করা হয়েছে, আমাদের (নিসচাও) পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল- ‘সড়ক পরিবহন ও সড়ক নিরাপদ আইন’। তারা সড়ক নিরাপত্তাটি বাদ দিয়ে সড়ক পরিবহন আইন করেছেন। এখানে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি যদি বাদ না দেওয়া হতো তাহলে অনিরাপদভাবে সড়ক তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্টরা দায়ী থাকতেন। যেহেতু সড়ক পরিবহন আইন হয়েছে, এই আইনের ভেতরে গাড়ি, চালক ও জরিমানার বিষয়টি রয়েছে। কিন্তু সড়ক নিরাপদের আনুষঙ্গিক যেসব বিষয়গুলো আসা দরকার ছিল সেগুলো আসেনি। আমরা সরকারের কাছে আবারও দাবি করছি- সড়ক নিরাপদের জন্য আলাদা আরেকটা আইন করা দরকার। জাতিসংঘে নিরাপদ সড়ক তৈরির বিষয়টি উল্লেখ করেছে। কারণ, সড়ক বানালেই হবে না, তা কতটা নিরাপদ; সেটিও গুরুত্ব দিতে হবে।

যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলেছে, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না থাকায় দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছেই। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী বা পঙ্গু হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি ১৭ বছরের কম বয়সি শিশু। এ হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছেন কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়। গতকাল শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানির তথ্য মিলেছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এই তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ আহত হচ্ছেন।

অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটির তথ্য মতে, হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি। এক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটি দাবি করছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫.৩ শতাংশ।

বুয়েটের এআরআই’র হিসাব বলেছে, গত ৩ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এমন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যদি নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে সেটিকে জনসংখ্যা বোনাস বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। বাংলাদেশ এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য গর্ব করে। সড়ক দুর্ঘটনা এ গর্বের জায়গাতেই বেশি আঘাত হানছে।

পুলিশের তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলেছে, গত একদশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু। এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, নিহতদের ৫১ শতাংশ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন হয় দেশে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ করা হয়। এরপর সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ ঘোষণা করে সরকার। ওই বছর থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এআই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বেপরোয়া গতি এবং চালকদের অনিরাপদ জীবনযাপন দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ। ফিটনেস ছাড়া যানবাহন সড়কে চললেও প্রশাসনের নজরদারি নেই। বাংলাদেশে অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চলে আসছে বছরের বছর ধরে। ফলে সড়কে প্রাণহানি কমার আশা করার কারণ নেই।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি- এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই। এছাড়া সড়কের শৃঙ্খলার অভাব তো আছেই। তিনি বলেন, ‘সড়ক খাতে শাসন বলে কিছু নেই। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে হলে আগে শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু কথা দিয়ে তো সড়ক নিরাপদ হবে না।

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষ্যে গত মঙ্গলবার বিআরটিএ সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ জন সড়কে নিহত হচ্ছেন। এমনকি আমরাও নিরাপদ নই... আমাদের সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তা করতে হলে আমাদের সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। পরিবহন মালিক থেকে শ্রমিক ও সড়ক ব্যবহারকারী- সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। তা না হলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না

ঢাকা শহরে ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হলে ১০০ ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজন। তবে আমাদের মাত্র পাঁচ থেকে ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট আছে। তাই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তারা র‌্যালি, মিছিল, প্রচারণাসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বলে জানান বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত