রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের প্রশ্ন

অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে নাক গলানো শিষ্ঠাচার পরিপন্থি

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি যাতে আগের মতো আগুন সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কাজ করতে না পারে, সেজন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আওয়ামী লীগের এমন পদক্ষেপ ও দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রশ্ন তুলেছেন। আগামী ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের সময় সরকার রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেবে কি না, সেই সম্পর্কে গত রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে তা জানতে চেয়েছেন পিটার হাস। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে রাষ্ট্রদূতের এ ধরনের প্রশ্ন নিঃসন্দেহে কূটনৈতিক শিষ্ঠাচারের পরিপন্থি বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল।

জানা গেছে, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী রাষ্ট্রদূতরা দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে কথা বলবেন, কাজ করবেন। এটিই হচ্ছে কূটনৈতিক শিষ্টাচার। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ তাদের নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের সরাসরি মন্তব্যের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। সর্বশেষ ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্টদূতের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কিছু মহল বিতর্কের জন্ম দিতে চাইলেও হালে পানি পায়নি। কিন্তু উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতের এমন মনোভাব। দেশের ভালোমন্দ এ দেশের মানুষই ঠিক করবে। সেখানে বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। পিটার হাস যে প্রশ্ন তুলেছেন তা কূটনৈতিক শিষ্ঠাচারের পরিপন্থি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে তিনি কী উদ্দেশ্যে এমন অযাচিত প্রশ্ন করলেন তা খুঁজে বের করা দরকার।

তবে পিটার হাসের এমন প্রশ্নের একদিন পরেই ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠকে আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সড়ক বন্ধ করার বিষয়ে আলোচনা হয়নি। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও হস্তক্ষেপমুক্ত অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

অন্যদিকে পিটার হাসের বৈঠকের বিষয়ে গতকাল সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফ মাহমুদ অপুর সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত সৌজন্য সাক্ষাতে আসন্ন নির্বাচন, ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ, চলমান দুর্গাপূজা, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, রাজধানীতে বড় কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। সেখানে তারা লোকসমাগম করবে। এ বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জানতে চেয়েছেন, বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সরকার রাস্তাঘাট, ঢাকার প্রবেশপথ বন্ধ করে দেবে কি না। তখন রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়েছে, সে ধরনের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছে। আশা করছি তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করবে। এতে আমাদের কিছু বলার নেই। সরকার চায় বিএনপি তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা ঠিকভাবেই করবে। এমনটি হলে কিছু বলার নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করার চিন্তা সরকারের নেই।

তবে ওইদিন বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পিটার হাস বলেছেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপি রাজধানীতে অনেক লোক জড়ো করবে। এ সময় সরকার রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেবে কি না? এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, শান্তিপূর্ণভাবে কোনো রাজনৈতিক দল সমাবেশ শেষ করলে তাদের কোনো কিছু বলার নেই। এখানে ১০ লাখের বেশি লোক নিয়ে আসা হলে একটা মিস ম্যানেজমেন্ট হতে পারে। যাতে সেটা না হয়, রাজনৈতিক দল যাতে রাস্তাঘাট বন্ধ না করে, তারা যেন মানুষের যাতায়াতের সুযোগ রাখে এই অনুরোধ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে।’

আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সচেষ্ট থাকবে শহর যাতে অচল না হয়, কোনো ধরনের ভায়োলেন্স না হয়। বিদেশগামী যাত্রী, চিকিৎসাপ্রার্থীরা যাতে শহরে আসতে এবং বের হতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হবে।’

আর পিটার হাস বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দুর্গাপূজার সব কর্মকাণ্ড শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রত্যাশা করছি। একই সঙ্গে পূজার পরে আগামী ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মহাসমাবেশসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিও শান্তিপূর্ণভাবে পালন হবে বলে আশা করছি।

গত শনিবার ‘মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ নির্মাণে ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, মার্কিন দূতাবাস যেন কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় হয়ে গেছে। আমেরিকার ভাব দেখে মনে হয় তারাই যেন গণতন্ত্রের ধারক-বাহক। সেখান থেকেই মনে হয় আসে কোথায় কি করবে। আমাদের ওপরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং ভিসানীতি প্রয়োগ করা হয়েছে। সুতরাং প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে।

আমেরিকা নিজেদের নির্বাচন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ফ্রান্সের নির্বাচন নিয়ে একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে মামলার দ্বারস্থ হতে হয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতির এক ছেলেকে দুর্নীতির দায়ে জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হতে হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা এমন ভাব করছে, মনে হচ্ছে তারা যেন পুতঃপবিত্র।

বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে গত বছরের ১৪ নভেম্বর জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি।’ আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না। ইতো নাওকি বলেন, কাজেই এখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার। এটাই তার দৃঢ় প্রত্যাশা।

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ বিদেশি কূটনীতিকদের বিভিন্ন তৎপরতা ও বক্তব্য মিডিয়ায় এসেছে। এগুলোকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা। নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশে অনুষ্ঠিতসহ স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বিভিন্ন মন্তব্য করছেন ও মতামত তুলে ধরছেন। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠান বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয় এবং এটা নিয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্য বা বক্তব্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা নাক গলানো বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীনরা।

সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের কথা বলাকে মোটেও তারা পছন্দ করছেন না। নির্বাচন একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। বাংলাদেশের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। সেই সংবিধানের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে এবং রীতিনীতি মেনে বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে যেভাবে নির্বাচন হয়, এখানেও সেভাবে নির্বাচন হবে। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো কিছু হবে না, বা কারো কোনো মতামত গ্রহণ করা হবে না বলে তারা জানান।

সরকার ও আওয়ামী লীগের ওই নীতি নির্ধারকরা আরো জানান, কূটনীতিকরা যেমন নির্বাচন নিয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করছেন, পাশাপাশি দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। এসব রাজনৈতিক দলের কারণেও কূটনৈতিকরা উৎসাহিত হয়। এ ধরনের তৎপরতা অগণতান্ত্রিক পরিবেশকে উৎসাহিত করে। দেশের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশ্বে বাংলাদেশ একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। কোনো তৎপরতায় অসংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক ধারা যাতে উৎসাহিত না হয় সে ব্যাপারে সরকার সতর্ক আছে। নির্বাচন বিদেশিরা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, কিন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের কোনো বিষয় সম্পর্কে কোনো অযাচিত মন্তব্য কাম্য নয়।

গত ১১ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের কাছে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা যথেষ্ট ম্যাচিউরড। আশাকরি, তারা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলবেন। আপনারা কূটনীতিকদের কাছে কেন ধরনা দেন?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সংবিধানের বাইরে চেষ্টা করে কোনো কিছু হবে না। কূটনীতিরা মনিটর করুক, সেটা তারা করতেই পারেন। অতীতে তাদের তৎপরতা ওয়ান ইলেভেনকে উৎসাহিত করেছিল, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদার জায়গায় চলে গেছে। আমাদের দেশের বিষয় নিয়ে কারো ছবক দেওয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা হয়, সাংবিধানিক ধারা মেনেই এখানে নির্বাচন হবে। এ নিয়ে কূটনীতিকদের চিন্তা করার দরকার নেই। আর যারা কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেয়, তাদের বলব, তারা যেন এটা থেকে বিরত থাকেন। বাইরের কোনো দেশকে যেন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলাতে উৎসাহিত না করেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে আগে থেকেই বিদেশি কূটনীতিকদের সতর্ক করা হচ্ছে যে, সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কোনো হস্তক্ষেপ দেখতে চায় না। কেননা, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করতে গিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশের রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। তিনি আরো বলেন, তবে এভাবে সব মিশনে মন্তব্য করা শোভনীয় নয়। বরং সরকারি দল এবং বিরোধী দল অর্থাৎ সব রাজনৈতিক দল যদি দায়িত্বশীল হয়, তবে বিদেশিদের নাক গলানোর কোনো সুযোগ থাকে না।