অপপ্রচারের নতুন কৌশল

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি!

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে। আগামী মাসে তফসিল ঘোষণা করে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচন কমিশন যখন প্রস্তুতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই বিভ্রান্তি ছড়াতে কৌশলে এই গুজবটি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আন্তরিকতার পরিচয় দিলেও রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ অসাংবিধানিক কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার প্রশ্নে অনড়। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হলেও বিএনপি দেশে সেই সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে। সেই সমাবেশ থেকে সরকার পতনের এক দফার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিটি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় ঘনিয়ে এলেও বিএনপির দাবি পূরণের কোনো সবুজ সংকেত মিলছে না। এ কারণে দাবি আদায়ের জন্য আরো সময় প্রয়োজন। আর এই সময় ক্ষেপণ করার জন্য তারা আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ জাগ্রত করছে। বিএনপির ধারণা বিদেশি শক্তি নির্বাচন অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করবে। ফলে বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করা বর্তমান সরকারের জন্য সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশ গ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিদেশি শক্তি গুরুত্বারোপ করলেও নির্বাচন বন্ধ কিংবা বিলম্বিত করতে চাপ প্রয়োগ করার মতো মনোভাব তাদের নেই। তবে এসব বিভ্রান্তিতে কোনো লাভ হবে না বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সঠিক সময়ে সংবিধান অনুযায়ী আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন উপলক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।

সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে ইসি। এতে সাংবিধানিক কোনো বাধা বা সংকট নেই। আগামী জানুয়ারির মধ্যে সুষ্ঠু ভোট করবে ইসি। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে যারা বাধা দিবে তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসানীতি কার্যকর করা হতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটের প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে ‘বড় ধরনের কোনো বাধা’ তারা দেখছেন না। তাদের আশা, নির্বাচনের আগেই নির্বাচনকে ‘অংগ্রহণমূলক’ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘সমঝোতা’ হতে পারে। তবে ‘সমঝোতা’ না হলে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, আগামী ২ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনের ৯০ দিনের ক্ষণ গণনা শুরু হবে। এজন্য ‘ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে’ নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাব্য লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে ইসি। আর নভেম্বরের ‘যে কোনো সময়’ তফসিল ঘোষণা। তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি এখন শেষ পর্যায়ে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যালট বাক্স, সিল, স্ট্যাম্প ও ব্যাগসহ ১৩ ধরনের নির্বাচনি উপকরণ কিনতে হয়। এসব উপকরণ কেনাকাটার কাজ এরইমধ্যে সেরে নিয়েছে কমিশন। গত রোববার থেকে নির্বাচনিসামগ্রী মাঠপর্যায়ে পাঠানো শুরু হয়েছে। এছাড়া গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের কর্মশালা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বিশেষ প্রস্তাব’ তৈরিসহ এখন সামনের দিনগুলোতে নির্বাচনের ‘চূড়ান্ত ধাপের’ কার্যক্রম চালাবে ইসি।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করা ছাড়া তাদের ‘গত্যন্তর’ নেই। তাই নির্বাচনের জন্য ‘প্রয়োজনীয়’ সব কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা তো এখন পর্যন্ত তেমন কোনো পরিস্থিতি দেখছি না যে, আমাদের সামনে কোনো বাধা-বিপত্তি আছে। সামনে বড় ধরনের কোনো বাধা দেখছি না। বাধা যেটা, সেটা আপনারাও জানেন, সবাই আমরা জানি যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেটা সমঝোতা একটা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। তখন পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমরা যথাসময়ে তফসিল দেব। আশা করছি যে, নভেম্বরের যে কোনো একটি সময়ে তফসিল দিয়ে দেব।

ইসি সূত্রে জানা যায়, এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যালট বক্স লাগবে তিন লাখের বেশি। এর মধ্যে ইসির হাতে আছে ২ লাখ ৬৭ হাজার। নতুন করে কেনা হয়েছে ৮০ হাজার। প্রথম লটে ৪০ হাজার ব্যালট বক্স ইসিতে পৌঁছে গেছে।

নির্বাচন নিয়ে বড় দুই দল দুই মেরুতে থাকায় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ‘বিশেষ সতর্কাবস্থায়’ রয়েছে ইসি। গত ৭ অক্টোবর নির্বাচন ভবনে মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ইসি। ওই বৈঠকের পর মাঠ কার্যালয়ের ‘নিরাপত্তা জোরদারে’ মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে চিঠি দেয় ইসি। এদিকে গত ১৪ অক্টোবর বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে বৈঠকে ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনে করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয় ইসি।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বিশেষ প্রস্তাব’ তৈরি করে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে কমিশনে উপস্থাপনের জন্য নির্বাচন পরিচালনা-২ অধিশাখাকে বলা হয়েছে। ওই প্রস্তাবে ‘বৈধ অস্ত্র প্রদর্শন ও নিষেধাজ্ঞা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনসহ সার্বিক পরিকল্পনা’ উল্লেখ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের শূন্যপদ পূরণ করতে আগামী ২৭ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেবে ইসি।

এর আগে আগামী ২৬ অক্টোবর ‘জাতির প্রত্যাশা’ নিয়ে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে কর্মশালা আয়োজন করবে কমিশন। এছাড়া আগামী ২৮ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল তৈরির জন্য বিভিন্ন অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সরকারি প্রচার মাধ্যম বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে নির্বাচনি প্রচারণা এবং দলীয় প্রধানের বক্তৃতা সম্প্রচারের নীতিমালা জারি করবে ইসি। একই সঙ্গে বেসরকারি প্রাথমিক ফলাফল প্রচারে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া প্রতিনিধির সঙ্গে সভা করবে কমিশন।

ইতিমধ্যে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, সিনিয়র জেলা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বিভাগীয় কমিশনারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ২৮ ও ২৯ অক্টোবর আবারো প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

এছাড়া ভোটগ্রহণের এক সপ্তাহ আগে ‘১০ লাখের মতো’ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশের নির্বাচন অফিসগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছে ইসি।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একটি মহল বাংলাদেশে অনির্বাচিত সরকার দেখতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সেই কারণে নির্বাচন বানচাল করতে পারলে একটি অনির্বাচিত সরকার এনে তাদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

গত রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় তিনি এসব কথা বলেন বলে একাধিক সংসদ সদস্য জানিয়েছেন। ভোট বানচালের ষড়যন্ত্র করতে বিএনপি শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসতে পারে বলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি উল্লেখ করেছেন। সংসদীয় দলের প্রধান শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সংসদ ভবনের সরকারি দলের সভাকক্ষে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠিত হয় এই বৈঠক। সেখানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

বৈঠকে জরিপের ভিত্তিতে যোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত ও সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী মনোনয়ন দেওয়া হবে। যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।