সর্বত্র কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা

আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কাটল দুর্গোৎসব ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রতিমা বিসর্জন

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

দশমী বিহিত পূজা ও দর্পণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার শেষ হয়েছে পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গাপূজা। সিদুর খেলা ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব সমাপ্ত হলো গতকাল বিজয়া দশমীর পূজার মধ্য দিয়ে। আবার শুরু হবে দেবী দুর্গার জন্য আগামী এক বছরের অপেক্ষার পালা। গতকাল সকালে ঢাকের বাদ্য, কাঁসার ঘণ্টা, শঙ্খের আওয়াজ আর উলুধ্বনি ও ভক্তি গীতির মধ্য দিয়ে দেবী বন্দনা করা হয়। বন্দনা শেষেই মণ্ডপে মণ্ডপে বিষাদের সুর বেজে ওঠে।

গত শুক্রবার ষষ্ঠীতে দেবীর বোধনের পর গত শনিবার নবপত্রিকায় প্রবেশ ও স্থাপনের পর শুরু হয় মহাসপ্তমীর পূজা। গত রোববার সকালে মহাঅষ্টমীর বিহিত পূজা হয়। অষ্টমীর সন্ধ্যায় হয় সন্ধিপূজা। গত সোমবার সকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে মহা নবমী পূজা।

নবমী তিথির সন্ধিপূজা শেষে মণ্ডপগুলো আলোক ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সব বয়সের মানুষ মেতে ওঠেন উৎসবে। ধূনচি, আলতি নাচ ও ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পূজামণ্ডপগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে। আলোক ছটার বর্ণিল রঙের ধারার মধ্যে মানুষ নির্মল আনন্দ উপভোগ করেন। পূজারীরা জানান, পূজার পাঁচ দিনই মায়ের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন করেছি। মায়ের কাছে অঞ্জলী দিয়েছি। অশুভ শক্তি বিনাশে প্রার্থনা করেছি। শুভশক্তির উদয়ে চন্ডিপাঠ করেছি। যুদ্ধবিগ্রহ, অন্যায়, অত্যাচার ও অনাচার নিরসনে মনের থেকে মায়ের কৃপা প্রত্যাশা করেছি। দশমীতে মাকে বিদায় দিতে না চাইলেও তারপরও দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মাকে বিদায় দিতে হচ্ছে। মা মর্ত্যলোক থেকে স্বর্গলোকে যাচ্ছেন। পৃথিবী শান্তিময় হোক এটাই মায়ের কাছে একমাত্র প্রার্থনা। গতকাল বিজয়া দশমী, দেবীদুর্গার বিদায়ের দিনে মণ্ডপে মণ্ডপে সকাল থেকে বাজতে থাকে বিষাদের সুর। দিনে গড়িয়ে বিকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্খ আর ঢাকের ধ্বনি ক্রমশ কমতে থাকে। শেষবারের মতো দেবী দর্শনে মণ্ডপে মণ্ডপে ভিড় করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সন্ধ্যায় বিসর্জন। তাই তো শেষ মুহূর্তে মঙ্গল কামনায় দেবীদুর্গার প্রতি একটু বেশিই মিনতি ছিল পুণ্যার্থীদের।

গতকাল সকাল থেকেই পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, বাংলাবাজার, ওয়ারী, শিংটোলার পূজামণ্ডপে চলে বিজয়া দশমীর পূজা অর্চনা। সকাল ১০টা থেকে সনাতনীদের ভোগ প্রধান, মন্ত্রপাঠ, সিঁদুর পরিক্রমা, যাত্রা মঙ্গল, সিঁদুর খেলা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা অর্চনার পর একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান। আত্মীয়স্বজন সবার জন্য মঙ্গল কামনা করেন তারা।

পুরোহিতরা জানান, পাঁচ দিন আমাদের রীতি অনুযায়ী ভালোভাবে পূজার সব কার্যক্রম শেষ করেছি। মা চলে যাচ্ছেন। মা স্বর্গ থেকে এবার ঘোড়ায় করে পৃথিবীতে এসেছিলেন। আবার ঘোড়ায় করে স্বর্গে চলে যাচ্ছেন। গত বছর তিনি ঘোড়ায় করে মর্তলোকে আসেন এবং নৌকায় করে স্বর্গে চলে যান। সকালে দেশের জন্য মঙ্গল কামনায় পূজা করা হয়েছে। দশমীতে পূজা করতে মণ্ডপে এসে পুণ্যাথীরা জানান, একটা বছর আমরা মায়ের জন্য অপেক্ষা করি। মা আসবেন, আশীর্বাদ করবেন। মায়ের কাছে নিজেদের জন্য চাইব। মা চলে যাচ্ছেন, অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে বিসর্জন দিতে হবে। পূজার আয়োজকরা জানান এবারের পূজা খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে। দশমীতে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়। সবাই সবাইবে শুভেচ্ছা জানান। সমাজ থেকে অশুভ দূর হোক, সবাই যেন ভালো থাকেন, সেই প্রার্থনাই করেছেন সবাই। গতকাল দুপুর ১২টার পর মণ্ডপ থেকে প্রতিমা নামানো কার্যক্রম শুরু হয়। বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়ায় আশপাশের সুবিধামতো জলাশয়ে।

প্রতিমা বিসর্জনে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নিরাপত্তা : সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিসর্জন ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন দিতে আসা ট্রাক চলাচলের রুট নির্ধারণ ও বিসর্জনে নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।

বিসর্জনের উদ্দেশ্যে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির মেলাঙ্গন থেকে কেন্দ্রীয় বিজয়া শোভাযাত্রা বের হয় বিকালে। এর আগে রাজধানীর ২৪৬টি পূজামণ্ডপ থেকে ভক্ত-পূজারিরা এসে জড়ো হন পলাশীর মোড়ে। সেখান থেকে সম্মিলিতভাবে বিজয়ার শোভাযাত্রা বের হয়। এরপর সদরঘাটের ওয়াইজঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীর জলে একে একে বিসর্জন দেওয়া হয় প্রতিমা।

রাজধানীতে বিজয়ার শোভাযাত্রা ও বিসর্জনকে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ, নৌপুলিশ, র‌্যাব ও আনসার বাহিনী একযোগে কাজ করে। বিশেষ করে, বুড়িগঙ্গা, সদরঘাটের ওয়াইজঘাটে, পুরান ঢাকার পোস্তগোলার শ্মশানঘাট ও লালকুঠির ঘাটে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন জানান, পূজার শুরু থেকেই প্রতিটি মণ্ডপে নিরাপত্তা দিয়েছে পুলিশ। বিসর্জনকে কেন্দ্র করে পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেওয়া হয়। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, সারা দেশে বিসর্জনে র‌্যাব বিশেষ নিরাপত্তা দেয়। নিরাপত্তার জন্য যা যা প্রয়োজন সবকিছু করা হয়। অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজও করে র‌্যাব। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র‌্যাবের স্পেশাল ফোর্স ও হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি এলাকায় কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। ব্যাটালিয়নের ইউনিট প্রধানরা পূজার নিরাপত্তা পরিদর্শনে যান।

র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে এলাকাভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। নৌপুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. শফিকুল ইসলাম জানানা, কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি যেন না হয় সেজন্য বিসর্জন উপলক্ষ্যে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে প্রতিটি মণ্ডপে। বিসর্জনে ঘাটগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিটি বিসর্জন ঘাটে স্বেচ্ছাসেবক কাজ করবে। যারা সাঁতার জানে এমন কয়েকজন ছেলেকে বাছাই করা হয়েছে, যাতে কেউ পানিতে ডুবে না যায়। বিসর্জন উপলক্ষ্যে দেশের প্রতিটি স্থানে নৌপুলিশ তৎপর রয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান জানান, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবে শুরু থেকে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়েছে। সবকয়টি মণ্ডপে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা ছিল। কিছু কিছু জায়গায় আর্চওয়ের ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেক পূজা উদযাপন কমিটির নেতা ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা পুলিশকে সহযোগিতা করেন। বিসর্জন কেন্দ্র করে ডিএমপির বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলয় তৈরি করা হয়। দেশজুড়ে ৩২ হাজার ৪০৭টি মন্দির-মণ্ডপে পূজা হয়েছে এ বছর।