ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নির্বাচন নিয়ে ইসির ভূমিকা আরো স্পষ্ট করতে বললেন সম্পাদকরা

নির্বাচনি পরিবেশটা পুরোপুরি অনুকূলে না থাকলেও নির্বাচন করব : সিইসি

নির্বাচনি পরিবেশটা পুরোপুরি অনুকূলে না থাকলেও নির্বাচন করব : সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্বাচনি পরিবেশটা পুরোপুরি অনুকূলে নেই। তবে এর অর্থ এই নয় যে, নির্বাচন করব না। নির্বাচনি পরিবেশ যেমনই থাক, আমরা সংবিধান অনুযায়ী সময় মতো নির্বাচন করব। অন্যদিকে গণমাধ্যমের সম্পাদকরা বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইসির ভূমিকা আরো স্পষ্ট করতে হবে।

গতকাল নির্বাচন ভবনে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : গণমাধ্যমের ভূমিকা, জাতির প্রত্যাশা’ শীর্ষক কর্মশালায় সিইসি এসব কথা বলেন।

কর্মশালায় পরিবেশ অনুকূলে না থাকা বিষয়ক সিইসির বক্তব্য নিয়ে প্রায় সবাই প্রশ্ন তোলেন। সম্পাদকরা বলেন, এটি সাংঘর্ষিক। কেন না, একদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে এমন বক্তব্য দেওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, আমি নিজেই টাইপ করতে পারি। সেজন্য হয়তো কিছু ভুলভ্রান্তি হতে পারে। ওখানে যে কথাটি বলেছি, তা খুব আন্তরিকভাবে বলেছি। প্রথম যেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলাম, সেদিন থেকেই বাধা দেখছি।

তিনি বলেন, আমাদের ফিল্ড যে খুব মসৃণ, তা কিন্তু নয়। সেজন্য আমরা আবেদন করেছি, আপনারাও চেষ্টা করেন নির্বাচনের পরিবেশ যেন আরো অনুকূল হয়ে ওঠে।

সিইসি আরো বলেন, ভাষাটা হয়তো ভুল হয়ে গেছে। আমি এখনো ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, পরিবেশটা পুরোপুরি অনুকূলে নেই। তবে এর অর্থ এই নয় যে, নির্বাচন করব না। আমি ‘নৌকা’ চালাই। স্রোতের অনুকূলে চালাতে পারি, প্রতিকূলে হলেও আমাকে চালাতে হবে।

এর আগে সম্পাদকদের সঙ্গে কর্মশালার শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে সিইসি বলেন, কোনো সংকট সৃষ্টি হলে তা নিরসনে আমরা অত্যন্ত আন্তরিক। আমাদের প্রত্যাশা প্রথম থেকেই ছিল। কিন্তু এখনো নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশটুকু পুরোপুরি তৈরি হয়ে ওঠেনি। আমাদের বিষয়টা হচ্ছে, আমরা যেটা চাই, আন্তরিক যে পরিবেশ সেটা অনুকূল হয়ে উঠুক। এজন্য সবাইকে নিরন্তর আহ্বান করে যাচ্ছি, সংলাপ করছি। যারা নির্বাচনে আসতে চান না তাদের আমার পক্ষ থেকে পত্র দিয়েছি। কিন্তু সাড়া পাইনি। রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কৌশল তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তাদের নিজস্ব কৌশল থাকতে পারে। আমরা তার মধ্যে অনধিকার চর্চা করব না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন’র সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, আমাদের যে ধারণাপত্র দিয়েছিলেন সেখানে বলা হয়েছে যে অবাধ, নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনো হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, প্রত্যাশিত সংলাপের মাধ্যমে মতভেদের নিরসন হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানতম দুই দল স্ব স্ব সিদ্ধান্তে অবস্থানে অনড় ইত্যাদি। আমার কথা হলো, যদি আপনারা মনে করে থাকেন এখনো অনুকূল পরিবেশ হয়নি, সেটা এক ধরনের সাংঘর্ষিক কি না। কারণ আপনারা তফসিল ঘোষণার দিকে যাচ্ছেন। হয়তো আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আপনারা যেমন মনে করেন তফসিল হতে পারে। যখন তফসিল ঘোষণার পূর্ব মুহূর্তে এই ধরনের বক্তব্য আসে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। তাহলে আমার কাছে প্রশ্ন হলো, যে আপনাদের ভূমিকাটা আরো স্পষ্ট করতে হবে, যে কী কারণে এখনো অনুকূল পরিবেশ হয়ে উঠেনি। অনুকূল পরিবেশ না হলে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে কি না, এবং অংশগ্রহণমূলক হওয়ার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হবে কি না? কারণ সাংঘর্ষিক অবস্থান থেকে, এই একটি বক্তব্য থেকে কোনো একটি দল বলতে পারে, আমি কেন নির্বাচনে আসব, কী কারণে আসতে হবে। আমার কী কারণে আসতে হবে।

তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন একটা সর্বোচ্চ ক্ষমতার জায়গা। একটা আস্থার জায়গা। একজন ভোটে অংশগ্রহণ করবে তখনই, যখন মনে করবে নির্বাচন কমিশন আমাদের অবাধ স্বাধীনতা দিতে সক্ষম হবে এবং ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। পরিবেশই যদি তৈরি না হয়, আপনারা কীভাবে নির্বাচনটা করবেন। ভোটকক্ষের ভেতর থেকে সরাসরি সম্প্রচারের গুরুত্বের বিষয়টি তুলে ধরেন নঈম নিজাম। তিনি বলেন, ভোটকক্ষে কেউ যদি কখনো ভেতরে গিয়ে বাধাগ্রস্ত করে, ভোটারদের জোর করে বের দেওয়ার চেষ্টা করে, সেখানে যদি সাংবাদিক, টেলিভিশন মিডিয়াকর্মী উপস্থিত থাকে, তিনি যদি তাৎক্ষণিক সম্প্রচারে চলে যান, তাহলে কী আপনারা আইনগত ব্যবস্থা নেবেন? নাকি এটুকু করতে দেওয়া হবে। সংবাদকর্মী যখন লাইভ করবে তখন কিন্তু ভয় করবে, সে (দুস্কৃতিকারী) কিন্তু ওখানে যাবে না। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেহেতু আপনারা বলছেন পরিবেশ নেই, সেহেতু সাংবাদিকরা কিন্তু ভালো কাজ করতে পারে ভোটকক্ষের ভেতরে।

নিউজটোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের নির্বাহী সম্পাদক রাহুল রাহা বলেন, আপনাদের কী করতে হবে, তা আপনারা সবই জানেন। তফসিল ঘোষণার পর থেকে সবকিছু নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। নির্বাচন কমিশনের কথার বাইরে আইন অনুযায়ী যাওয়ার কোনো সুযোগ দেশের আইনে নেই। ফলে কমিশন এককভাবে সব দায়িত্ব পালন করে এটি যেমন সত্য, তেমনি একইভাবে সত্য যে কমিশন এককভাবেই নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করে। নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনেই হচ্ছে নির্বাচন। বিদ্যমান যে সরকার থাকে তারা শুধুমাত্র কমিশনকে সাপোর্ট দেয়। রাহুল রাহা আরো বলেন, সংঘাত থাকবে সেটা রাজপথে। সবাইকে নিয়ে বসার চেষ্টা করবেন। সবাইকে নিয়ে পথ চলার পথে আমি যেতে চাই। তবে দেশের ভেতরে যারা আছে তাদের পরামর্শটা শোনাই মূল বিষয়। যারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বাস করে, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সিভিল সোসাইটি সবার কথা আমরা শুনতে চাই। সবার কথা শুনবেন। বাইরের সুপরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাইরের কারো ইনস্ট্রাকশনে দেশ চলবে না। ওইটুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশ আমরা আমাদের সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত করব। ভারতের নির্বাচনের সময় সংঘাতে বহু লোক নিহত হয়। আমাদের এখানে নির্বাচন কমিশন এত ভালো দায়িত্ব পালন করে মৃত্যুর ঘটনা প্রায় ঘটেই না। আমি সহিংসতার বিন্দুমাত্র পক্ষে না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ইলেকশন করে যাওয়া ছাড়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই। ফলে নির্বাচন কমিশনকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে এবং বিতর্কিত কোনো বক্তব্য দেয়া যাবে না। ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যালট পেপার ভোটকেন্দ্রে সকালে আসবে। যেটা আপনারা ঘোষণা করছেন, এটা যেন পিছিয়ে না যায়। আপনারা যেন চাপে না পড়েন। দরকার হলে ব্যালট পেপার স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে পাঠিয়ে দেন। দরকার হলে ব্যালট পেপার ব্যাংকের ভল্টের মধ্যে থাকবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে। তবে এই সাংবিধানিক শূন্যতা যাতে তৈরি না হয়। সংবিধানের মধ্যদিয়ে যেন প্রতিযোগিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচন হয়, সেজন্য আপনাদের কাজ করতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সেনাবাহিনী নিয়োগ থেকে শুরু করে সব কিছুই আপনারা করতে পারবেন। পরিবেশ যদি না হয়, তাহলে আপনারা কি করবেন। আপনারা একদিক দিয়ে বলছেন অবাধ করবেন, আবার বলছেন পরিবেশ হয়নি। আপনাদের বলতে হবে পরিবেশ হয়নি পরিবেশ করে ফেলব। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে ইসির আস্থা ও সংকট নতুন নয়। রাতারাতি কিছু করবেন- এটা কাম্য নয়। আপনারা কমিশনে অন্য মেয়াদে থাকবেন। এই মেয়াদ শেষ হলে জনগণ যাতে বলতে পারে একটা কমিশন ছিল। এই উদাহরণ তৈরি করে যাবেন। যারা রাজপথে আছেন তাদের মধ্যে ধারণা তৈরি করে দিতে হবে যে আপনারা ভোটে আসেন পরিবেশ আছে। আজকে এইটুকু প্রত্যাশা করব আপনারা যখন চলে যাবেন তখন আপনাদের সবাইকে যেন স্মরণ রাখে। এটা যেন সর্বশ্রেষ্ট দায়িত্ব হয়। কিছু কিছু সময় সত্য কথাটা না বললেও ভালো। নির্বাচনের হয়তো আড়াই মাস আছে, আপনারা বলেছেন নির্বাচনে অনুকূল পরিবেশ এখনো হয়ে উঠেনি। কেউ যদি বলেন অনূকূল পরিবেশ হয়নি তাহলে নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হবে। তাই কিছু কিছু বক্তব্য যতই সত্য হোক, অনুচ্চারিত থাকাটাই ভালো।

ইকবাল সোবহান বলেন, আপনারা ৫ বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। আশা করব আপনারা যেন পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এখান থেকে যাওয়ার সময় আপনাদের নিজেদের মধ্যে যেন আত্মতৃপ্তি থাকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত