আজ বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

টানেল যুগে বাংলাদেশ বদলে যাবে অর্থনীতি

* প্রত্যাশিত ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ এখন বাস্তব * শুরুতে দৈনিক চলবে ১৭ হাজার ২৬০ গাড়ি * উদ্বোধন পতেঙ্গা প্রান্তে, সমাবেশ আনোয়ারায়

প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চালুর মাধ্যমে বদলে যাবে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের অর্থনৈতিক চিত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালেই চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা অংশে টানেল উদ্বোধন করবেন। এরপর টানেল পার হয়ে অপরপ্রান্ত আনোয়ারা এলাকায় সুধী সমাবেশে ভাষণ দেবেন তিনি। এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এই টানেলের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখন হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হাতছানি দিচ্ছে। চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউনের স্বপ্ন’ এখন বাস্তবরূপ লাভ করছে। টানেলটি আজ উদ্বোধন হলেও গাড়ি চলবে আগামীকাল থেকে। সেই সঙ্গে শুরু হবে টানেল যুগে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘টানেল চট্টগ্রাম অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে। টানেলের সড়ক একসময় এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হয়ে দাঁড়াবে। এমন মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। কিছুদিন পর সমুদ্রের পাড়ে বে-টার্মিনাল চালু হবে। সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মযজ্ঞ হবে। মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোদমে চালু হলে লাখ লাখ মানুষ সেখানে থাকবে, যার প্রভাব নগরীতে পড়বে। টানেলের অপর প্রান্তে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড, চীনা শিল্পাঞ্চল, মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ চট্টগ্রামে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে বাড়বে জনসমাগম।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা বলছেন, টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেক দূর এগিয়ে যাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এরই মধ্যে আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেলকে ঘিরে পর্যটন ও শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৫ থেকে ৬ মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতি গতি পাবে।

টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে করা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, টানেল চট্টগ্রামের অর্থনীতির গতি পরিবর্তন করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল অর্থনীতি, যোগাযোগ এবং পর্যটন খাতে ব্যাপক অবদান রাখবে। বিশেষ করে এটি হবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এগিয়ে নেওয়ার রোডম্যাপ। টানেলের আশপাশের এলাকায় নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নতুন শাখা খোলাসহ ব্যাপক বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। চট্টগ্রাম-ঢাকা এবং কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে টানেল। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের যোগান দেবে এই টানেল।

টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।

মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তবে সংযোগ সড়কসহ টানেলের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব। এর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি। এরমধ্যে একটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্থ ও ১৬ ফুট উচ্চতার। চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে টানেলটি নদীর তলদেশ হয়ে চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানেল প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি। গত ১৮ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এ কাজের জন্য চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়োগের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে। শনিবার উদ্বোধনের পর ব্যবহার শুরু হচ্ছে স্বপ্নের টানেলের।

টানেলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরে চট্টগ্রাম চেম্বারের কয়েকজন পরিচালক বলেন, চট্টগ্রাম নগরের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সংযোগ তৈরি করবে টানেল। এটি হলে সাংহাইয়ের আদলে নদীর দুই পাড়ে তৈরি হবে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। টানেলের মাধ্যমে আলোর মুখ দেখবে ১৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভও। কক্সবাজারের মহেশখালীতে বাস্তবায়িত হওয়া ৭২টি প্রকল্পের সঙ্গে চট্টগ্রামের সংযোগ সেতুও তৈরি করতে যাচ্ছে এই টানেল। মিরসরাই ইকোনমিক জোনে যে কর্মযজ্ঞ হচ্ছে সেটির সুফলও পাওয়া যাবে এই টানেলে। পদ্মা সেতুর মতো জাতীয় অর্থনীতিতে এই টানেলও রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

পরিচালকরা বলেন, টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে তৈরি হবে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। হাজার কিলোমিটার দূরের সেই শহরের মতো চট্টগ্রামেও সিটি থাকবে একটি। কিন্তু নদীর দুই তীরে থাকবে দুটি টাউন। এ জন্য এটির স্লোগান ‘ওয়ান সিটি টু টাউন।’ এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকছে। আর আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। টানেল চালু হওয়ার আগেই পরিবর্তনের হাওয়া দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রামে। এখনই অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। টানেল চালু হওয়ার পর এ হার বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।

টোল আদায় প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, শাহ আমানত সেতুতে এখন প্রাইভেটকার ও জিপের টোল দিতে হয় ৭৫ টাকা। টানেল দিয়ে চলতে এসব গাড়িকে গুনতে হবে ২০০ টাকা। এটি সেতুর টোলের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি। পিকআপের জন্য শাহ আমানত সেতুতে ১৩০ টাকা গুনতে হলেও টানেলে এটির টোল ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। সেতুতে মাইক্রোবাস চালাতে দিতে হয় ১০০ টাকা। কিন্তু টানেলে গুনতে হবে আড়াই গুণ বেশি; ২৫০ টাকা। ৩১ আসনের কম ধারণ ক্ষমতার বাস সেতুতে ৫০ টাকা গুনলেও টানেলে গুনতে হবে ৩০০ টাকা। এটি সেতুর তুলনায় ছয় গুণ বাড়ানো হয়েছে। ৩২ আসনের বেশি ধারণ ক্ষমতার বাস সেতুতে ১৫৫ টাকা দিলেও টানেলে গুনতে হবে ৪০০ টাকা। ভারী যানবাহনের টোল তুলনামূলকভাবে বেশি রাখা হয়েছে টানেলে। ৫ টন ধারণ ক্ষমতার ট্রাক সেতুতে ১৩০ টাকা দিলেও টানেলে দিতে হবে ৪০০ টাকা। একইভাবে ৫ থেকে ৮ টন ধারণ ক্ষমতার ট্রাক সেতুতে ২০০ টাকা দিলেও টানেলে ৫০০ টাকা। আপাতদৃষ্টিতে এটি বেশি মনে হলেও সার্বিক দিক বিবেচনা করলে টোল হার সহনীয় মনে হবে।

টানেল নিয়ে থিম সং : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হয়েছে দেশের একমাত্র সুড়ঙ্গপথ ‘টানেল’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ টানেলের নামকরণ করা হয়েছে। এটি নির্মাণে সময় লেগেছে দীর্ঘ ৭ বছর। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ টানেল প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন। স্বপ্নের এই টানেল প্রকল্পের সঙ্গে মিশে আছে দেশের কোটি মানুষের আবেগ-ভালোবাসা। দেশের প্রথম এই সুড়ঙ্গপথ টানেল প্রকল্পের উদ্বোধন স্মরণীয় করে রাখতে যুক্ত হয়েছেন শিল্পীরাও। টানেলকে নিয়ে তৈরি হয়েছে শ্রুতিমধুর এক থিম সং (অফিসিয়াল গান)। যে গানটি বাজানো হবে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। এ ছাড়াও প্রচারিত হবে বিটিভিতে। গানটির শিরোনাম ‘বাংলার মুকুটে যোগ হলো আরো এক রঙিন পালক’।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্যোগে থিম সংগীতটির কথা লিখেছেন প্রকৌশলী ড. আবদুল্লাহ আল মামুন। পেশাগত জীবনে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এই প্রকৌশলী গীতিকার হিসেবে সুপরিচিত। ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’সহ কালজয়ী বিভিন্ন গান রচিত হয়েছে তার হাতে। গানটির সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন চট্টগ্রামেরই সন্তান কণ্ঠশিল্পী শাহরিয়ার খালেদ। সুর সাজানোর পাশাপাশি গানটিতে তিনিও কণ্ঠ দিয়েছেন। এ গানে আরও কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী অনুপমা মুক্তি, ডা. শর্মিলা বড়ুয়া, সাব্বির জামান ও গৌরী দাশ। গানটি প্রযোজনা করেছেন বিটিভির নির্বাহী প্রযোজক ইলন সফির।