ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ড. কামাল হোসেনের অব্যাহতির ঘোষণা রাজনীতি থেকে

ড. কামাল হোসেনের অব্যাহতির ঘোষণা রাজনীতি থেকে

গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. কামাল হোসেন দল থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে দলের বিশেষ জাতীয় কাউন্সিলে মাধ্যমে এ ঘোষণা দেন প্রবীণ রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন।

জানা গেছে, ড. কামাল হোসেন ১৯৩৭ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ড. কামাল হোসেনে বাংলাদেশের সংবিধানের স্থপতি। এছাড়াও তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিরলস সমর্থক এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অবিচল রক্ষক। একজন আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবী হিসাবে তিনি দেশের রাজনৈতিক ও আইনি পটভূমিতে গভীর প্রভাব রেখেছেন। ড. কামাল হোসেন অন্যান্য বিশিষ্ট আইনজীবীদের সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিনিধিত্ব করেন। সে সময় আইন বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি তার দক্ষতা এবং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার প্রদর্শন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ড. কামাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারে আইনমন্ত্রী, তেল ও খনিজসম্পদ মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। বিশিষ্ট সাংবিধানিক আইনজীবী হিসেবে ড. কামাল হোসেন মৌলিক মানবাধিকার, বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় তার কর্মজীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি একইসঙ্গে বাংলাদেশ লিগাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি এবং সভাপতি। এটি একটি আইনি সংগঠন যারা প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আইনি সেবা দেওয়ার দিকে বিশেষ নজর দেয়। তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সভাপতি ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউট উল্লেখযোগ্য।

গণফোরামের ভাঙনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে দলের বিশেষ জাতীয় কাউন্সিলে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমি সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে তথা, গণফোরামের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছি। দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আপনাদের নিয়ে পথ চলেছি। দেশের জাতীয় সমস্যা ও সংকট নিরসনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এখন আর সক্রিয়ভাবে সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না।’

জানা যায়, ২০২০ সালের শুরুর দিকেই ভাঙনের মুখে পড়ে গণফোরাম। ওই বছরের মার্চে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন দলটি কার্যত দুই ভাগ হয়ে যায়। একটিতে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে থাকেন ড. রেজা কিবরিয়া। আর দ্বিতীয় গ্রুপটির নেতৃত্বে আছেন মোস্তফা মহসীন মন্টু ও অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তাদের সঙ্গে আছেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জগলুল হায়দার আফ্রিক, অ্যাডভোকেট মহসীন রশীদ। ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দলীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী, জগলুল হায়দার আফ্রিক, হেলালউদ্দিন, লতিফুল বারী হামিম, খান সিদ্দিকুর রহমান ও আবদুল হাসিব চৌধুরীকে বহিষ্কার করা হয়। এদের মধ্যে হেলাল, লতিফুল, সিদ্দিকুর ও হাসিব চৌধুরীকে আগে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার একদিন পরেই কামাল হোসেনের অংশের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া, সহ-সভাপতি মহসীন রশীদ, সহ-সভাপতি আ ও ম শফিকউল্লাহ ও যুগ্ম সাধারণ মোস্তাককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। মাঝখানে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও দলীয় সদস্যপদ থেকে রেজা কিবরিয়ার পদত্যাগসহ বেশকিছু ঘটনা ঘটে। তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গণফোরামের ভাঙন আরও দৃশ্যমান হয়। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর গণফোরামের একাংশের কাউন্সিলে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে সভাপতি ও সুব্রত চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর গত বছরের ১২ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে গণফোরামের দু’পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের একাংশের কাউন্সিলে আরেক অংশের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ ওঠে। এতে কামাল হোসেনের অংশের নির্বাহী সভাপতি মোকাব্বির খান এমপিসহ প্রায় ২০ জন নেতাকর্মী আহত হন। সেই সঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে ঢুকে কাউন্সিলের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করা হয়। পরে পুলিশ এসে এক পক্ষকে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে বের করে দেয়। সেদিন গণফোরামের কাউন্সিল ঘিরে দলটির বিদ্যমান দু’গ্রুপের মধ্যে দিনভর উত্তেজনা বিরাজ করে। এদিনে কামাল হোসেনের অংশ জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে কাউন্সিলের আয়োজন করে। অপরদিকে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন অংশ প্রেসক্লাবের সামনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মানববন্ধনের আয়োজন করে। সেদিন হামলাকারীরা বলেন, মোকাব্বির খানসহ এই অংশের নেতাকর্মীরা সরকারের দালাল। আবার হামলার বিষয়ে মোকাব্বির খান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাউন্সিলের আয়োজন করেছি। এটা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি, কিন্তু কিছু দুষ্কৃতকারী কাউন্সিলে হামলা করে আমাকেসহ আরও অনেককে আহত করেছে। এটা গণতন্ত্রের ওপর হামলা। গণফোরাম থেকে বহিষ্কৃতরা এই হামলা চালিয়েছে। সেই ঘটনার পরপরই গণফোরামের ভাঙন আরও প্রকাশ্যে আসে। এরপর থেকেই ঢিমে-তালে চলে দুই অংশের কাজ। সেই সঙ্গে দুই অংশই নিজেদের আসল গণফোরাম দাবি করে। এরমধ্যে গেল ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি ও ডা. মো. মিজানুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে গণফোরামের ১০১ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওইদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে সংবাদ সম্মেলনে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরে কমিটির ১০১ সদস্যের নাম পড়ে শোনান নতুন সাধারণ সম্পাদক। এর দুদিন পরই মন্টুর নেতৃত্বাধীন অংশ সংবাদ সম্মেলন করে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ও তার সেক্রেটারি ডা. মিজানুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।

প্রসঙ্গত, ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ১৯৯৩ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে বেরিয়ে আসা সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিককে সঙ্গে নিয়ে গণফোরাম গঠন করেন। পরে মানিক মারা গেলে আওয়ামী যুবলীগ থেকে আসা মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলটি বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে অংশ নিয়ে প্রথম সংসদে যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত