ঢাবির ‘বিশেষ সমাবর্তন’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দেব

* বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যেন থেমে না যায় * মুষ্টিমেয় নয়, উন্নতি হতে হবে সার্বজনীন

প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিনিধি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেক রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এই স্বাধীনতার সুফল আমরা প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দেব। এই বাংলাদেশে একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না, ভূমিহীন থাকবে না। এই দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করার আমরা করে যাচ্ছি। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আয়োজিত বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে যারা শিক্ষার্থী, যাদের বয়স ২০ বছর, তারা উপলব্ধিও করতে পারবে না ২০ বছর আগের বাংলাদেশ কী ছিল। সেখানে ক্ষুধা ছিল, দারিদ্র্য ছিল, জ্ঞান-বিজ্ঞানে কোনো অগ্রগতি ছিল না। ১৯৯৬ সাল থেকেই তো আমরা প্রযুক্তি শিক্ষা, কম্পিউটার শিক্ষা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ করার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আমি একটা কথাই বলতে চাই, আমরা আমাদের দেশকে সারা বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। দেশের চলমান উন্নয়ন যাতে কখনোই বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্যও তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা আজকের প্রজন্ম, তাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ২০০৯ সালে থেকে আমরা সরকারে। এই ১৫ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ হচ্ছে আজকের এই বাংলাদেশ। সেটা আমরা করতে পেরেছি জাতির পিতার প্রতিটি কথা, প্রতিটি বাণী হৃদয়ে ধারণ করে তার স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা গ্রহণের মাধ্যমে। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমার এটাই আহ্বান থাকবে যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে দিয়ে এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার যতটুকু করার আমি করে যাচ্ছি। কিন্তু এরপরে যেন বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা থেমে না যায়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন আমরা করতে পেরেছি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আমরা করতে পেরেছি। যদিও করোনা এবং যুদ্ধ শুধু আমাদের না, বিশ্বে একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।’

গবেষণার ওপর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আরো গুরুত্বারোপ করা আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাই, গবেষণা যেন হয়। গবেষণার ওপর যেন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কৃষি গবেষণায় আমরা খুব সাফল্য অর্জন করেছি। আজকে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। সেই সাথে আমাদের বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান থেকে শুরু করে আমরা তো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি, দ্বিতীয়টাও আমরা করব। এরপর তো আমাদের চাঁদে যেতে হবে। সেই চাঁদে যাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে আমি কিন্তু লালমনিরহাটে অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ও করেছি।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র থাকার সময় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি আদায় করতে গিয়ে বহিষ্কার হওয়া বঙ্গবন্ধু মুচলেখা দিয়ে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখেননি। কারণ, তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপষ করেননি।’ জাতির পিতার সেই বহিষ্কারাদেশ ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন চ্যান্সেলর প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান এবং ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককেও ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এটা আমার হৃদয়ের বিশ্ববিদ্যালয়। আবার যদি ভর্তি হতে পারতাম, মাস্টার্স ডিগ্রিটা শেষ করতে পারতাম খুশি হতাম।’ কারণ ’৭৫ এর বিয়োগান্তক অধ্যায়ের পর জীবনের গতিপথ পরিবর্তনে তার আর মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করা হয়নি।

জাতির পিতার কন্যা বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক ডিগ্রি পেয়েছি ওতে মন ভরে না। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে পেলাম না। অবশ্য আমাকে একটা অনারারি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেটাতো না, লেখাপড়া করতে পারলে ভালো হতো।’

অনুষ্ঠানে একাডেমিক কাউন্সিল ও বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদানের ঘোষণা দেন এবং জাতির পিতার কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ডিগ্রি তুলে দেন। শেখ হাসিনা জাতির পিতার পক্ষে স্বাক্ষর করে ডিগ্রি গ্রহণ করেন। প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এসএম মাকসুদ কামাল ডিগ্রি প্রদানের সাইটেশন পাঠ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। সমাবর্তন বক্তার সাইটেশন পাঠ করেন প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ। কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুসহ মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, আমন্ত্রিত দেশের বিশিষ্ট নাগরিকসহ সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।

জাতির পিতাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ প্রদানের দিনে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত তার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটি আমার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা হিসেবে বিশেষ সম্মানের একটি বিশেষ দিন, যে দিন আপনারা আমাকেও ভাষণ দিতে ডেকেছেন।’

শেখ হাসিনা স্মরণ করেন, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির পিতারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই আসা আর হয়নি। ঘাতকের নির্মম বুলেট শুধু জাতির পিতাকেই নয়, তার মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ভাই, নবপরিণীতা দুই ভাতৃবধূসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের জীবন কেড়ে নেয়। তিনি বলেন, আমি কন্যা হিসেবে এটুকু বলতে পারি আমার বাবা কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকেই বেশি ভালোবেসেছেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তার জীবনটা তিনি উৎসর্গ করেছেন। তিনি যতটা এদেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন সেই ভালোবাসা দিয়েই এদেশের মানুষের ভাগ্য গড়তে চেয়েছেন। জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন এবং দেশ স্বাধীনের পর এই যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশটিকে তিনি গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেন। কিন্তু ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিন হাতে সময় পেয়েছিলেন। তারপরও সে সময়েই দেশকে তিনি স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে তুলে দিয়ে যান।

অর্জনগুলো ধরে রেখে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা এই দেশের জন্য যে মহান আত্মত্যাগ করে গেছেন সেটা আমাদের ভুললে চলবে না। আজকে আমাদের তৈরী হতে হবে আগামী দিনের জন্য। তিনি জাতির পিতার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’ এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে রচিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ সিরিজের বইগুলো পড়ে দেখার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। কেন না, ’৭৫ এর পর ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্রে নতুন প্রজন্মকে বহুদিন দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, জাতির পিতা সেই ’৭৩ সালে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয় যতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেগুলোর জন্য আইন করে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে যান। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা বিদ্যাপীঠ, যেখানে সবাই শিক্ষা গ্রহণ করবে, গবেষণা করবে এবং গবেষণার ফসল হবে দেশের উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক মুক্তি। বাঙালির সব অর্জনের সূতিকাগার এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ আর ’৭৫ পরবর্তী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারি যে সামরিক জান্তারা একের পর এক ক্ষমতায় এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামও এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়েছে। ’৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়েই এর প্রতিবাদে মিছিল হয়েছিল।’

তিনি তখনকার ছাত্রনেতাদের সেই প্রতিবাদ শুরু করায় কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যখনই কোনো মিলিটারি ডিক্টেটর ঢুকতে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কারণ, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি অর্জন এবং এর সংগ্রামের পাদপীঠ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী হিসেবে সেসব উত্তাল দিনগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে সরাসরি অংশ নেয়ার স্মৃতিচারণ করে এজন্য গর্ব অনুভব করেন বলেও জানান। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের সঙ্গে তার সম্পর্ক সেই স্কুল জীবন থেকে উল্লেখ করে তিনি আজিমপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন স্কুলের দেয়াল টপকে ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলন কিংবা ইডেন ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রী থাকার সময়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলন সংগ্রামের সারথী হওয়ার স্মৃতিচারণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশ গড়াটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। আমার কাছে প্রধানমন্ত্রীত্ব কিছু না। প্রধানমন্ত্রী হলে বহু আগেই হতে পারতাম। কিন্তু সেভাবে আমি চাইনি। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, ক্ষমতা হবে জনগণের কল্যাণ সাধন করা। জাতির পিতা যেভাবে বলেছেন, সেভাবে দেশকে গড়ে তোলা। সেই প্রচেষ্টাই আমি চালিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের যারা লেখাপড়া শেখে তারা যেন ওই গ্রামের মানুষকে ভুলে না যায়। তাদের যত উন্নতি হবে, দেশও তত উন্নত হবে। মুষ্টিমেয় লোকের উন্নতি নয়, উন্নতি হতে হবে সার্বজনীন। গ্রামের একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে আমাদের উন্নয়ন আসতে হবে, সেটাই আমাদের প্রচেষ্টা। বঙ্গবন্ধুকে ‘ডক্টর অব লজ’ প্রদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।