ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দুই প্রকল্পের উদ্বোধন

এবার রেলপথে নতুন স্বপ্ন

এবার রেলপথে নতুন স্বপ্ন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া-আগরতলা আন্তঃসীমান্ত রেলসংযোগ যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযোগ বাড়বে। একইসঙ্গে খুলনা-মংলা বন্দর রেললাইন প্রকল্পটি ভারতের রেয়াতি লাইন অব ক্রেডিট দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। যা মংলা বন্দরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন সুযোগের সূচনা করবে। রেলপথ চালু হওয়ায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর মংলা ব্রডগেজ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে ভার্চুয়ালি রেলপথ প্রকল্প দুটি উদ্বোধন করেন।

আখাউড়া-আগরতলা আন্তঃসীমান্ত রেলসংযোগের পাশাপাশি খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। রেলপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার। এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই রেলপথের মাধ্যমে মংলা বন্দরের পণ্য একদিকে যেমন দেশের মধ্যে কম খরচে পরিবহণ করা যাবে, অন্যদিকে ভারত, নেপাল ও ভুটান এই পথ ব্যবহার করে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করবে। ফলে দক্ষিণের অর্থনীতির অগ্রগতিতে রেলপথটি বড় ভূমিকা রাখবে। এছাড়া আখাউড়া-আগরতলা আন্তঃসীমান্তে আপাতত পণ্যবাহী ট্রেন চলবে। পর্যায়ক্রমে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করা হবে। আগরতলা থেকে আখাউড়া হয়ে বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে কলকাতা যাতায়াতে দূরত্ব ও সময় উভয়ই কমবে। এই রেলপথ আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের দূরত্ব কমে ৩৫০ কিলোমিটার হয়েছে।

আখাউড়া-আগরতলা ক্রস-বর্ডার রেল সংযোগ প্রকল্পটি ৩৯২ দশমিক ৫২ কোটি টাকা ভারতের অনুদান সহায়তায় বাস্তবায়িত হয়েছে। ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটারের রেল সংযোগ প্রকল্পটির ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেললাইন বাংলাদেশে এবং ৫ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার ত্রিপুরায়। খুলনা-মংলা বন্দর রেলসংযোগ মোট প্রকল্প ব্যয় ৩৮৮ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলার (ভারতীয় এলওসি থেকে ৬৯ দশমিক ১৮ শতাংশ অর্থায়ন)। প্রায় ৬৪ দশমিক ৭ কিলোমিটার রেললাইনের নির্মাণ কাজ ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হয়েছে।

জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় থেকে আমদানি করা পাথর প্রথমে ট্রেনে করে আগরতলার জিরানীয়া স্টেশনে আনা হয়। সেখান থেকে ভারতীয় ট্রাকে করে বাংলাদেশে আনা হয়। ভারতীয় ট্রাক পাথর রেখে যাওয়ার পর বাংলাদেশি ট্রাকে করে নেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। এখন থেকে আর একাধিকবার পরিবহণের মাধ্যমে পাথর আমদানি করতে হবে না। ভারতের মেঘালয় থেকে সরাসরি পাথরবাহী ট্রেন চলে আসবে বাংলাদেশে। এরপর সেখান থেকে বাংলাদেশি ট্রাকে করে পৌঁছে দেওয়া যাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাথর আমদানির পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতেও ব্যবসায়ীদের সুযোগ বেড়েছে।

আখাউড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, সড়ক কিংবা রেলপথে আগরতলা পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে দ্বিগুণ খরচ হয়। এবার আখাউড়া ও আগরতলা সরাসরি রেলপথ চালু হওয়ায় পণ্য পরিবহণ ব্যয় যেমন কমবে, তেমনি তিন থেকে চারভাগ কম সময় লাগবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলপথে প্রথমে মালবাহী ও পরে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করবে। যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করলে আখাউড়া-আগরতলা-কলকাতা পথের দূরত্ব অনেক কমে যাবে। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ার পাশাপাশি পর্যটনেও যাত্রী বাড়বে। দুই দেশের এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১২.২৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ৬.৭৮ কিলোমিটার। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন ৫৭ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণ ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ কোটি টাকা।

২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্প নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রথমে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ১৮ মাস। এরপর করোনার প্রভাবসহ নানা কারণে পাঁচ দফা এর মেয়াদ বাড়ানো হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মাস দুয়েক আগেই রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এরপর থেকেই অপেক্ষা ছিল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের। কিন্তু নানা কারণে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক করা যাচ্ছিল না। অবশেষে দুই দেশের মধ্যে আলোচনাক্রমে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় নির্ধারণ হয়। যা গতকাল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরো বাড়ল।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবু জাফর বলেন, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক রেলপথ উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে গতকাল থেকে মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে যাত্রীবাহী ট্রেনও চলাচল করার কথা রয়েছে। আখাউড়া স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ চালু হওয়ায় দুই দেশের বাণিজ্যে আরো গতি বাড়বে। বিশেষ করে পাথর ও গম আমদানি আমাদের সহজ হবে। ভারতের ট্রেন সরাসরি বাংলাদেশে চলে আসায় কমবে পরিবহণ ব্যয়। আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) অংগ্যজাই মারমা বলেন, রেললাইন প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে মৈত্রীময় সম্পর্ক সেটির উদাহরণ। এ প্রকল্পটি চালুর মধ্য দিয়ে দুই দেশই লাভবান হয়েছে।

আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ-ভারতের রেল কানেক্টিভিটি বেড়েছে। নতুন রেলসংযোগ উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম রুট হতে চলেছে আখাউড়া-আগরতলা। উভয় দেশের মধ্যে রেলপথে সংযুক্ত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।

এ ব্যাপারে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে রেল চলাচল করত। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় এই রেলপথগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এই বন্ধ রেললাইন সংস্কার করে পুনরায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেলসংযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে রেলপথে যাত্রী পরিবহণের পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি-আমদানি প্রসার লাভ করবে। জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে ৮টি স্থান দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে সরাসরি যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করত।

এগুলো হলো, বাংলাদেশের দর্শনা ও ভারতের গেদে, বাংলাদেশের বেনাপোল থেকে ভারতের পেট্রাপোল, বাংলাদেশের রোহনপুর থেকে ভারতের সিঙ্গাবাদ, বাংলাদেশের বিরল থেকে ভারতের রাধিকাপুর, বাংলাদেশের শাহবাজপুর থেকে ভারতের মহিশাসন, বাংলাদেশের চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ী, বাংলাদেশের বুড়িমারি থেকে ভারতের চ্যাংড়াবান্দা ও বাংলাদেশের মোগলহাট থেকে ভারতের মহিশাসন পর্যন্ত রেলপথ ছিল। এসব রেলপথের বেশিরভাগেই ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে যায়। কিছু আবার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরে বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে পাঁচটি রেলপথ চালু হলেও এখনো তিনটি রেলপথ বন্ধ রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত