আউশ মৌসুমেও ধান সংগ্রহে স্মার্ট কৃষির ছোঁয়া

কম্বাইন হারভেস্টরের আওতায় ১৯ ভাগ

সাশ্রয় ৩৩৪ কোটি টাকা

প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে কৃষিযান্ত্রিকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশে। এরই মধ্যে ধানের দুই মূল মৌসুম তথা বোরো ও আমন মিলে ১৭ ভাগের কিছু বেশি জমির ধান স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তথা আমদানিকৃত কম্বাইন হারভেস্টরের মাধ্যমে কর্তনের আওতায় চলে এসেছে।

বাকি আউশ মৌসুমেও কৃষকরা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে ব্যাবহার করতে শুরু করেছেন যান্ত্রিক হারভেস্টর। মাত্র ৩ বছরের মধ্যে ঘটে গেছে এই পরিবর্তন। আউশে ১০ লাখ ৪৩ হাজার হেক্টরের মধ্যে ১৯ শতাংশের কিছু বেশি জমির ধান এ বছর কৃষক সমাজ যান্ত্রিকভাবে সংগ্রহ করেছেন। কৃষি শ্রমিকের এই অপ্রতুলতার সময়ে কম খরচ ও সময়ে ধান সংগ্রহের ফলে আর্থিক সাশ্রয় প্রায় ৩৩৭ কোটি টাকা। সম্প্রতি কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলাওয়ারি তথ্যে উঠে এসেছে এই পরিসংখ্যান। সরকারের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মারফত ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র প্রদানের ফলে পাওয়া গেছে এই সাফল্য বলে জানান চুয়াডাংগা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা। তিনি বলেন, তার জেলার ৪৩ হাজার ০১৭ হেক্টর জমি আউশের আওতায় এসেছিল, যার মধ্যে ৩০ হাজার ৮৩৬ হেক্টরই কম্বাইন হারভেস্টর দিয়ে কাটা হয়েছে। কম মূল্যে ধানকাটা ও সংগ্রহ পর্যায়ে অপচয় রোধ হওয়ার কারণে কৃষকদের সম্মিলিত সাশ্রয় এ জেলায় ৫৫ কোটি টাকারও বেশি। ৯ হাজার টনের ওপর বেশি ধান শুধু কম অপচয়ের কারণে কৃষকের হাতে থেকে গেছে যার ন্যূনতম বাজার মূল্য ২৫ কোটি টাকা। বরগুনা জেলার কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম বলেন বাংলাদেশে তার জেলা আউশ মৌসুমে যান্ত্রিকভাবে ধান সংগ্রহে এখন প্রথম। ভর্তুকিতে কম্বাইন হারভেস্টরের সহজলভ্যতার কারণে অনেক অবস্থা সম্পূর্ণ তরুণ কৃষক যন্ত্রটি কিনেছেন। তাদের ও সব পর্যায়ের কৃষিকর্মীদের ব্যাপক উৎসাহে যন্ত্রটি কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়েছে। ভর্তুকি মূল্যে ৩৩৮টি কম্বাইন হারভেস্টর এই জেলার তরুণ কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তারা কিনেছেন। এ বছর ৪৪ হাজার ১৫৫ হেক্টর জমি আউশ চাষের আওতায় এসেছিল, তার মধ্যে ৩৫ হাজার ১১৩ হেক্টর জমির ধানই কম্বাইন হারভেস্টর দিয়ে কাটা হয়েছে। হাতে ধান কাটার থেকে যন্ত্রে খরচ অর্ধেক হওয়ার কারণে ও সংগ্রহ পর্যায়ে অপচয় রোধের ফলে এই জেলায় আর্থিক সাশ্রয় ৬৩ কোটি টাকার বেশি। প্রতি হেক্টরে কৃষকের বাড়তি আয় প্রায় ৯ হাজার ৯৮০ টাকা। এ বছর ৭৯.৫২ শতাংশ জমি যান্ত্রিক সংগ্রহের আওতায় এসেছে, সদর উলজেলায় সেটা এখনই ৯০ শতাংশ, আগামী বছর এ পরিমাণ আরো অনেক বাড়বে আশা করা যায়। দক্ষিণের জেলাগুলোর মধ্যে ভোলাতে ৪৫ শতাংশ, পটুয়াখালীতে ৩০ শতাংশ আউশের জমি কম্বাইন হারভেস্টিং-এর আওতায় এসেছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়। উত্তরের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোরের ২০ থেকে ৩২ শতাংশ আউশের জমি যান্ত্রিক কর্তনের আওতায় এসেছে। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার কৃষক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টিপাত কম হবার কারণে এই বছর ৬ বিঘা জমিতে আউশ আবাদ হয়েছে গত বছর যেখানে ১০ বিঘার উপরে চাষবাস করেছিলেন। সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে এলাকায় কম্বাইন হারভেস্টর দিয়েছে। পাশের গ্রামের হারভেস্টর মালিক এখন প্রতি বিঘা জমিতে ১৮০০ টাকায় ধান কাটা ও মাড়াই করে দিচ্ছে। গত বছর কিষানেরা (কৃষি শ্রমিক) ৩৫০০-৩৬০০ টাকা নিয়েছিল। আর এইবার এক দিনেই আমার ধান কাটা শেষ যার কারণেও অনেক সাশ্রয় হয়। সেচের পেছনে এবার খরচ বেড়েছে, বৃষ্টি ছিল না মে ও জুন মাসজুড়ে, পাম্পের পানি দিতে হয়েছে। পানির অতিরিক্ত খরচ কম্বাইন হারভেস্টর পুষিয়ে দিয়ে বাড়তি কিছু লাভেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলে জানান এই উত্তরের কৃষক। সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, আমন ও বোরো মৌসুম মিলিয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ জমির ধান যান্ত্রিক সংগ্রহের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাংলাদেশে কম্বাইন হারভেস্টর দিয়ে ধান কাটা হতো ৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে দাঁড়িয়েছে আমন মৌসুমে ১১.২২ ও বোরো মৌসুমে ২২.১৭ শতাংশ। গড়ে প্রায় ১৭ শতাংশ। আউশেও ২ লাখ হেক্টরের বেশি জমির ধান এবার যান্ত্রিকভাবে কাটা হয়েছে। এর ফলে জাতিয় পর্যায়ে মোট তিন মৌসুম মিলিয়ে ১৯ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর ধানী জমির ফসল যান্ত্রিক সংগ্রহের আওতায় এলো। তিনি বলেন, কৃষক রত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় কৃষিমন্ত্রী ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধায়নে ২০২০-এর বোরো মৌসুম থেকেই বাংলাদেশে নেওয়া হয় এক বিপ্লবী পরিকল্পনা যন্ত্রায়ন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প, যা বাংলাদেশে স্মার্ট কৃষির গোরাপত্তন করে। ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার এই প্রকল্প আনুষ্ঠানিক ৩ বছর পার করেছে জুন ২০২৩ এ। প্রকল্পের আওতায় ১২ ধরনের যন্ত্র হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলে ৭০ শতাংশ এবং সমতলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে ৮ হাজার ৭১৯টি কম্বাইন হারভেস্টরসহ মোট ৩৩ হাজার ৬১২টি কৃষিযন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এসব কৃষিযন্ত্র কৃষি ও কৃষকের জীবন বদলে দিচ্ছে। স্মার্ট কৃষির প্রবর্তন হচ্ছে দেশে।