মেট্রোরেলে উত্তরা-মতিঝিল

সহজ যাতায়াতে নির্মল বিনোদন

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রাজধানীর যানজট নিরসনে যোগাযোগ খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে মেট্রোরেল। এরই মধ্যে বহু মানুষ সহজ যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে মেট্রোরেলের সুবিধা পাচ্ছেন। মেট্রোরেলের আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের উদ্বোধন করা হবে আজ। বহু প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল সার্ভিসের দ্বিতীয় ধাপের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পরদিন থেকেই সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে ঢাকার আধুনিক এই গণপরিবহন ব্যবস্থার নতুন অংশটি। এতে ব্যাংকপাড়া মতিঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয় ও পল্টন এলাকার সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ মেট্রোরেলের সুবিধা পেতে যাচ্ছেন। এছাড়া আসন্ন শীতের মৌসুমে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলার মানুষের সহজ যাতাযাতের পাশাপাশি নির্মল বিনোদন হয়ে উঠবে মেট্রোরেল। মেট্রোরেলের প্রথম কোচটি শুধু নারীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নারীদের চলাচল নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগ নেয়। এতে নারী যাত্রীদের স্বস্তি ফিরেছে। ঢাকায় গণপরিবহনে চলাচলে নারীদের যে ভোগান্তি পোহাতে হয়, সেখানে এক স্বস্তির জায়গা তৈরি করে দিয়েছে মেট্রোরেল। মেট্রোরেলে সংরক্ষিত কোচ ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়ে সোহেলি আক্তার বলেন, মেট্রোরেলে নারীদের আলাদা কোচ ব্যবস্থা থাকায় স্বস্তি ও নিরাপদে যাতায়াত করা যায়। ভিড় থাকলেও এক কোচে যখন সবাই নারী, তখন অস্বস্তি থাকবে না।

রাজধানীর বিনোদন কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি মেট্রোরেল বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। সব মিলিয়ে বাড়তি বিনোদন কেন্দ্রই যেন বনে গেছে দেশের প্রথম বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল। মতিঝিল এলাকা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর মানুষের মধ্যে বিনোদনের মাত্রা যেন আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে।

পল্টন এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, উত্তরা ও আগারগাঁও মেট্রোরেল যখন চালু হয়েছে, তখন একবার উঠেছি। মতিঝিল পর্যন্ত চালু হলে আবারো উঠার ইচ্ছে রয়েছে তার। কারণ মেট্রোরেলে ঘুরতে সিরাজুলের ভালো লাগে।

মতিঝিল এলাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন শামসুল হক। মেট্রোরেলে চড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মেট্রোরেলে এখনও চড়া হয়নি। সন্তানদের নিয়ে একদিন চড়বো, ওদেরও ঘোরা হলো নিজেও’র ঘোরা হলো।

মেট্রোরেল এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। দ্রুত ও নিরাপদ যাত্রা এবং ভাড়া কম হওয়ায় বাড়ছে চাপ। এরপরও ঢাকায় প্রথমবার যারা আসেন, তাদের অনেকেই মেট্রোরেলে চড়তে চান। তেমনি মাদারীপুরের তানিয়া আকতার ঢাকায় চাকরির পরীক্ষা দিতে এসে মেট্রোরেলে উঠতে চান। তিনি বলেন, মেট্রোরেল চালু হলেও কখনও ওঠার সুযোগ হয়নি। চাকরির পরীক্ষা দিতে এসে পরিবারসহ ঘুরতে পারলে খুব ভালো লাগবে।

জানা গেছে, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল সেকশনের দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৭২ কিলোমিটার। মেট্রোরেলের দ্বিতীয় অংশে ৬টি স্টেশন থাকলেও প্রথম দিকে এই অংশে ফার্মগেট-সচিবালয়-মতিঝিল স্টেশনে মেট্রোরেল থামবে। আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট ভাড়া ২০ টাকা, ফার্মগেট থেকে সচিবালয় ৩০ টাকা, সচিবালয় থেকে মতিঝিল ২০ টাকা, ফার্মগেট থেকে মতিঝিল ৩০ টাকা, উত্তরা থেকে মতিঝিল ১০০ টাকা। তবে স্থায়ী পাস নিলে ১০ শতাংশ ছাড় মিলবে। এছাড়া উত্তরা-মতিঝিল রুটে ৫ নভেম্বর থেকে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত মেট্রো চলাচল করবে।

মেট্রোরেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরা ও আগারগাঁও মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ছিলেন মতিঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, মতিঝিল ও পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। দীর্ঘদিন ধরে অফিসগামী মেট্রোরেল যাত্রীদের প্রত্যাশা ছিল সকালের দিকে সময় যেন বাড়ানো হয়। সেটি বিবেচনায় নিয়ে আগামীকাল থেকে মেট্রোরেল সকাল সাড়ে ৭টা থেকে চলাচল শুরু করবে। যাদের এমআরটি বা র‌্যাপিড পাস রয়েছে তারা রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলাচল করতে পারবেন। আর যেসব যাত্রী স্টেশন থেকে একক টিকিট কাটবেন তারা রাত ৮টা পর্যন্ত সর্বশেষ মেট্রোরেলে চলাচল করতে পারবেন।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, একটি লাইনে মেট্রোরেল পরিষেবার উদ্বোধন ও অন্য লাইনের নির্মাণকাজ উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রতিটি স্টেশনের এন্ট্রি ও এক্সিট পয়েন্ট নির্মাণ, ফুটপাত উন্নয়ন এবং এসকেলেটর স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক যাত্রী ট্রেনে যাতায়াত করলে মেট্রোরেলের নিচে অবস্থিত সড়কে ছোট-বড় যানবাহন সংখ্যা কমবে। এতে একদিকে কর্মঘণ্টা বাঁচবে, অপরদিকে গাড়ির জ্বালানি এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতের ব্যয়ও কমবে। উত্তরা হতে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘপথে চলাচল করতে পারবেন যাত্রীরা। পুরো পথ যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সময় সাশ্রয়ের (টাইম কস্ট) কারণে দৈনিক প্রায় ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং গাড়ির অপারেশন খরচ বাবদ আরো ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে; যা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে।

জনগণের সুবিধার কথা বিবেচনা করে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার পথ বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত অংশ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে। প্রতিটি ট্রেন ২ হাজার ৩০০ যাত্রী নিয়ে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। তবে বাঁকযুক্ত এলাকায় গতি কমে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে নানা উদ্যোগ নেয়। যানজট নিরসনে রাজধানীজুড়ে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মেট্রোরেল আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী এবং প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী বহন করতে সক্ষম হবে এবং প্রতি চার মিনিটে প্রতিটি স্টেশনে একটি ট্রেন আসবে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মেট্রোরেল নির্মাণ করছে এবং প্রকল্পে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। জাইকা প্রকল্পের জন্য ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এমএনএ সিদ্দিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী আজ আগারগাঁও স্টেশন থেকে আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের উদ্বোধন করবেন। তারপর মতিঝিল স্টেশনে আরেকটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য তিনি মেট্রোরেল নিয়ে মতিঝিলের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। এই অংশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কারণে আজ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নিয়মিত মেট্রো চলাচল বন্ধ থাকবে।

ডিএমটিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর রুট) নির্মাণ কাজেরও উদ্বোধন করবেন। এই লাইন হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা হয়ে গাবতলী, মিরপুর-১০, গুলশান পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার হবে। ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৮ সালে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানী ঢাকায় দেশের প্রথম এলিভেটেড মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন। এরপর উত্তরা-আগারগাঁও মেট্রোরেলের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। এরই মধ্যে এই অংশের সব স্টেশন চালু হয়েছে।