ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অবরোধে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম

অবরোধে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম

সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল কমেছে। এতে বাজারে নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীরা বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সরবরাহ কমে যাওয়ায় সবজির দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কারওয়ানবাজার ও যাত্রাবাড়ী ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতাল-অবরোধে বিভিন্ন জেলার পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ঢাকায় প্রবেশ কমেছে। আবার যে দু-চারটি সবজি ও নিত্যপণ্যের ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করছে সেগুলোর তিনগুণ ভাড়া বেশি গুণতে হচ্ছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের। ট্রাকের এই বাড়তি ভাড়ার চাপ গিয়ে পড়েছে ক্রেতাদের উপর।

জানা গেছে, হরতাল-অবরোধে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান সংকটে বিভিন্ন বন্দরে আটকে পড়া কাঁচামালও সংগ্রহ করতে পারে না ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাহত হয় উৎপাদন, যার প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানিতেও। বেশিরভাগ হরতালেই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।

পাইকারী বাজার ছাড়াও খুচরা বাজার হিসেবে পরিচিত উত্তরা কামারপাড়া, মহাখালী, শনিরআখড়া, মাতুয়াইল ও শ্যামলী বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত ২৮ অক্টোবরে আগে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮০ টাকা। হরতাল-অবরোধের পর পেঁয়াজের কেজি দাঁড়িয়েছে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়। আলুর কেজি ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা থেকে ২২০ টাকায় পৌঁছেছে। কাঁচা সবজি বাদেও অন্যান্য পণ্যের দামেও ঊর্ধ্বগতির দিকে।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী সোহেব আলী বলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় কার্যত ভেঙে পড়েছে দেশের পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা। সরবরাহ ঘাটতিতে পাইকারি ও খুচরা বাজারে বাড়ছে পণ্যের দাম। হরতাল-অবরোধে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ভাড়া বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। আগের ২০ হাজার টাকার ভাড়া এখন গুনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এর পরও মিলছে না গাড়ি। সড়কপথের পাশাপাশি নৌ ও রেলপথেও পণ্য পরিবহণ এবং সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে স্থবির হয়ে আছে স্থলবন্দরগুলো। হরতাল, অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, পণ্যবাহী পরিবহণে আগুন, সব মিলিয়ে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাজারের ঊর্ধ্বগতি দেশের মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। দিনমজুর ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য মাছ-মাংস খাওয়া একেবারে কঠিন হয়ে গেছে। মুরগির কথা বাদই দিলাম, চাষের মাছও তো নাগালের বাইরে। চলমান হরতাল-অবরোধে পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সীমিত আয়ের মানুষ পড়েছেন বড় বিপদে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও বাজারের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না মানুষ।

বাজারে শীতকালীন নতুন সবজি উঠতে শুরু করলেও দাম বেশি। বাজারে ১ কেজি করলা ১২০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকা, পটোল ১০০ টাকা ও ঝিঙা ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল থাকলেও কমেনি আদা-রসুনের দাম। প্রতি কেজি আদা মানভেদে ২৪০ থেকে ৩১০ টাকা, আর রসুন ১৬০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা শুকনা মরিচের কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। ফুলকপি ও বাঁধাকপি আকারভেদে ১০০ থেকে ১৭০ টাকা প্রতি জোড়া বিক্রি হচ্ছে। লাউ ৬০ থেকে ১০০ টাকা দামে। এছাড়া কাঁচা পেঁপে ৪০, বেগুন, কাঁকরোল, টমেটো, কচুমুখী বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকায়। দেশি শসা, করলা, মুলা বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। এছাড়া গাজর ১২০ টাকা, শিম ১৪০ টাকা এবং ধনেপাতা ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে রুই ও কাতল আকারভেদে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। চাষের কৈ ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও দেশি কৈ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। এছাড়া পাবদা ৪০০, তেলাপিয়া ২৫০ এবং পাঙাশ প্রতি কেজি ২২০ টাকা এবং ডিমের হালি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ টাকা দরে। খাসির মাংসের দাম প্রতি কেজি ১ হাজার ১০০ টাকা। প্রতি কেজি ছোলার দাম মানভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আবার প্রতি কেজি বুটের ডাল গত সপ্তাহে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। বেসনের কেজি ১২০ টাকা।

বাজারে ক্রেতাদের অভিযোগ, তদারকির আমদানি কমে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে রাজধানীর বাজারগুলো। তবে বিক্রেতারা বলছেন, শীতকালীন সবজি বাজারে এলেও বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর অবরোধে যানবাহন চলাচল কমেছে, সেজন্য সবজির সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক হলে সবজির দাম কমবে।

বাজারে নিত্যপণ্য দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কাজল সরকার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে আবার হরতাল-অবরোধে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেকায়দায় পড়েছেন। তিনি বলেন, দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ, বাসাভাড়া, দৈনিক বাজার খরচ- সব মিলিয়ে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করা তার পক্ষে বর্তমানে অসম্ভব হয়ে উঠছে। তার মাসিক ব্যয় ২২ হাজার ৪৮০ টাকা। অথচ তার দিনে আয় হয় মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। অর্থাৎ ৭০০ টাকা করে হলে মাসে মোট ২১ হাজার টাকা। হরতাল-অবরোধে তার সাংসারিক খরচ বেড়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। একই অবস্থা কড়াইল বস্তির লায়লা বেগমের। মাছের দাম অনেক বাড়তি, খুব কমই সবজিই আছে, যেগুলোর দাম এখন কেজিপ্রতি ৬০ টাকার নিচে। তাই তার মতো গরিবদের সংসার আর চলে না। টিসিবির কার্ডও তারা পাচ্ছে না। অনেক সময় টিসিবির ৫ কেজি চাল ১৫০ টাকার বদলে ২০০ টাকায়ও কিনতে হয়।

মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকায় রিকশাচালক আকবর মিয়া বলেন, ভালো-মন্দ খাওয়ার কথা এহন আর চিন্তাও করি না। সবজি, ডিম, ডাল কোনোটারই দাম কম নাই। সারা দিন রিকশা চালাইয়াও খরচ পুষাইতে পারি না। বিএনপির অবরোধে ঢাকায় আবারও সবজির দাম বেড়েছে। পল্টনের এক বাণিজ্যিক ভবনে স্বল্প বেতনে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন তপন বিশ্বাস। কাজ আগের মতোই আছে, বেতনও আগের মতো; কিন্তু জীবন আর আগের মতো নেই। তপন বলেন, এই আয়ে আগে যেমন চলা গেছে, এখন আর তেমন চলা যায় না। চাহিদার সাথে অনেক আপস করতে হয়। আগে একটু বেশি খাইলে, এখন কম খাই।

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ মো. বশির উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা কীভাবে স্বাভাবিক কেনাবেচা করবেন। সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়ছে। আমরা এ অবস্থা মেনে নিতে পারছি না। দোকান খুলতে পারছি না।

এসএম ট্রেডার্সের মালিক বকুল হোসেন বলেন, হরতালে বিক্রি হয়নি। অবরোধেও কিছু বেচাকেনার আশায় দোকান খুলে বসে থাকি। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই। বাইরের ক্রেতা ঢাকায় ঢুকতে না পারলে পাইকারি বেচাকেনা হবে না। ঢাকার বাইরের অর্ডারও আসছে না। ট্রান্সপোর্টের গাড়ি বন্ধ। আগের অর্ডারের মাল পাঠাতে পারছি না। এভাবে চললে আমাদের ক্ষতি বাড়বে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, হরতাল-অবরোধে ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ছে। প্রতিটি দলকে সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। যে কর্মসূচি অর্থনীতিকে আরো বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেটা আমাদের প্রত্যাশিত নয়।

প্রসঙ্গত, রাজধানী নয়াপল্টনে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল। বাসে অগ্নিকাণ্ড, পুলিশ বক্সে আগুনও বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় কারণে মহাসমাবেশ করতে পারেনি দলটি। পরের দিন হরতাল ও তিন দিনের অবরোধের ডাক দেয় বিএনপি-জামায়াত ইসলাম। নতুন করে দেয়া সারাদেশে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি আগামীকাল সকাল ৬টায় শেষ হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত