পথে পথে উৎসুক জনতার ভিড়

প্রথম ট্রেন এলো সমুদ্র শহর কক্সবাজারে

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র শহর কক্সবাজারে স্বপ্নের রেললাইন উদ্বোধন হচ্ছে ১১ নভেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করবেন। আর তারই জন্য গতকাল রোববার চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা দেয়া ট্রেন কক্সবাজার এসে পৌঁছেছে। সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটের সময় ট্রেনটি এসে পৌঁছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ আইকনিক রেলস্টেশন কক্সবাজারে। মূলত উদ্বোধনের আগে প্রকল্পটি রেল চলাচলের উপযোগী কি না তা দেখতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ট্রেনটির যাত্রা। রোববার সকাল ৯টা ২ মিনিটে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে কক্সবাজার অভিমুখে যাত্রা শুরু করে প্রথম ট্রেনটি। রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক রুহুল কাদের আজাদের নেতৃত্বে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই ট্রেনে ছিলেন। ৮টি বগি সম্বলিত বিশেষ এই ট্রেনে থাকা কর্মকর্তারা যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে প্রকল্পটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আর কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের পর চূড়ান্ত অনুমোদন মিললে এই রেললাইন ট্রেন চলাচলের উপযোগী হিসেবে ঘোষণা করা হবে।

আগামী ১১ নভেম্বর নতুন এই রেলপথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের কথা রয়েছে। ৭ নভেম্বর এখানে ট্রায়াল ট্রেন চালানোর কথা ছিল। তবে পরে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে রেলওয়ে।

কক্সবাজার রুটের প্রথম ট্রেনটি চালিয়ে এনেছেন লোকোমাস্টার মাহফুজুর রহমান ও সহকারী লোকোমাস্টার মো. রুকন মিয়া। তারা বলেন, কক্সবাজারের প্রথম ট্রেন যাত্রা করার মাধ্যমে আমরা ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।

ট্রেন ছাড়ার আগে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নাজমুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাধারণত নিয়ম হলো নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হলে রেলপথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এটাও সেটির অংশ। এটা কোনো ট্রায়াল ট্রেন নয়। আমাদের সঙ্গে আছেন রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক রুহুল কাদের আজাদ। তিনি পরিদর্শনের পর যদি সার্টিফাই না করেন তাহলে ট্রেন পরিচালনা করতে পারব না। যাওয়ার জন্য নিরাপদ বললে আমরা যেতে পারব। আমাদের সঙ্গে ট্র্যাক, সিগনাল ও বৈদ্যুতিক বিভাগের প্রকৌশলীরাও আছেন। সবাই মিলে রেলপথ মূল্যায়ন করবেন।

এই পথে ট্রেন যাওয়ার অন্যতম বাধা ছিল শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু। এই সেতুতে গত আগস্ট মাসে সংস্কার কাজ শুরু হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের একদল বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে। শুরুতে সেতুটি রেল চলাচলের উপযোগী করা হয়। গত শনিবার ৬৩ টন, ৭৮ টন এবং সর্বোচ্চ ভারী ৯০ টনের ইঞ্জিন পরীক্ষামূলক চালানো হয়েছে রেল সেতুতে। সফলভাবে এই কার্যক্রম শেষের পর এই রেলপথে ট্রেন চালানোতে আর বাধা রইল না। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা বলেন, সেতু সংস্কারকাজ ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ওয়াকওয়ে ও ঢালাইয়ের কাজ বাকি। তবে ট্রেন চলাচলের উপযোগী। বাকি শেষ হতে মাসখানেক সময় লাগবে।

রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০১০ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করা। পাশাপাশি মিয়ানমারসহ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত আগে থেকেই রেললাইন আছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথের কাজ চলছে। এই রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাকি খরচ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে সরকারের অগ্রাধিকার এই প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে। প্রকল্পের আওতায় ১০০ কিলোমিটার রেললাইন ছাড়াও কক্সবাজার সদর, রামু, ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারীতে মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে প্রকল্পটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কক্সবাজারের ‘আইকনিক’ ঝিনুক আকৃতির স্টেশনটি। উদ্বোধনের আগে সবক’টি স্টেশন চালু হবে না। তবে আইকনিক স্টেশনটি প্রস্তুত। ১১ নভেম্বর উদ্বোধন হলেও বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু করবে ১ ডিসেম্বর থেকে।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীণ বলেন, প্রকল্পটির ৯৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। উদ্বোধনের পর বাকি কাজ চলবে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ রয়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের অন্তত আটটি উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হওয়ার পাশাপাশি এই রেলপথ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে বলেও অভিমত বিশেষজ্ঞদের।