ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বর আজ

* মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস পালন করবে আওয়ামী লীগ * কোনো কর্মসূচি নেই বিএনপির

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বর আজ। ১৯৭৫ সালের আজকের এই দিনে ইতিহাসের আরেক রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয়েছিল। সিপাহি জনতার বিপ্লবের নামে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা এবং একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা সৈনিককে নৃৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যদিও ৭ নভেম্বর নিয়ে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিন্ন ভিন্ন নামকরণে দিবসটি পালন করে থাকে। ৭ নভেম্বর বিএনপি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ বললেও আওয়ামী লীগ ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ হিসেবে দিনটি পালন করছে। কারণ ক্যু-পাল্টা ক্যুসহ অনেক নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের এ দিনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রতি বছরই ৭ নভেম্বর এলে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা হয়। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করা হয় কে কাকে উদ্ধার করেছেন। কে কাকে হত্যা করেছেন- এসব নিয়ে বিস্তর আলাপও হয়। তবে এই দিনে দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা কোনোভাবেই বিপ্লব নয়। এটি মূলত মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ধারাবাহিকতায় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা এবং পরবর্তী সময়ে নভেম্বরে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত করা হয়। যেখানে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখা তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ, তার দুই সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল এটিএম হায়দারকে। এছাড়া হত্যা করা হয় আরো বহু মুক্তিযোদ্ধা সৈনিককে। তবে এখনো দিবসটি নিয়ে বিতর্ক আছে।

৭ নভেম্বর ঘিরে সোচ্চার থাকছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা : স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের হত্যাযজ্ঞের ওপর ভর করে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে। সৈনিকদের ব্যবহার করে, মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রক্তের ওপর দিয়ে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের ভিত্তি রচনা করে তিনি। একই সঙ্গে এই রাতের দুর্বত্তায়নের সঙ্গে জড়িতদের পদায়ন করে বিভিন্ন স্থানে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের নিষ্ঠুরভাবে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচারের প্রক্রিয়া রুদ্ধ করে দেন। এজন্য এই দিনটিকে রাজনৈতিক রং দিয়ে ‘জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় জিয়ার নির্দেশে। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট নিয়মিত এই দিনটিকে উদযাপন করে আসছে। অথচ, এটি বাঙালি জাতির ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় দিন। শোকের দিন এটি, কান্নার দিন। সেজন্য ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ হিসেবে অভিহিত করে রাজধানীসহ সারাদেশে নানা কর্মসূচি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনৈতিক উত্থাপন-পতনের মধ্যদিয়ে বিএনপি নামে দলটির জন্ম হয়েছিল। তবে শুরুতে একাধিকবার নাম বদল করে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল এককথায় অস্বাভাবিক।

আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ৭ নভেম্বর নিয়ে যা বলা হয়েছে সেটি হলো- ‘তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের নামে ১৯৭৫ সালের এদিন থেকে শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ঘাতকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। একই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জেলখানার অভ্যন্তরে ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এর মাত্র চার দিন পরই ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৫ সালের এদিনে তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের নামে প্রথমে হত্যা করা হয় তিন খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধাকে। এরা হলেন- খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, কেএন হুদা বীর উত্তম এবং এটিএম হায়দার বীর বিক্রম। দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে অবস্থানকালে সকালে তাদের একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে দুজন কোম্পানি কমান্ডার আসাদ এবং জলিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৭ নভেম্বর জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন, শোকের দিন, কান্নার দিন। এই দিনে জিয়াউর রহমান হত্যাযজ্ঞের ওপর ভর করে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। সৈনিকদের ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রক্তের ওপর দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় প্রত্যাবর্তনের ভিত্তি রচনা করেন জিয়াউর রহমান। একই সঙ্গে এই রাতের দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িতদের পদায়ন করেন বিভিন্ন স্থানে। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের নিষ্ঠুরভাবে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচার প্রক্রিয়াও রুদ্ধ করে দেয় জিয়া। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ৭ নভেম্বর রাজনৈতিক রং দিয়ে জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় জিয়াউর রহমানের নির্দেশে। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট নিয়মিত এই দিনটি উদযাপন করে আসছে।

বিএনপির কর্মসূচি স্থগিত : ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করার জন্য চলমান অবরোধ একদিন বিরতি দিয়েছে বিএনপি। তবে গত মাসের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ ঘিরে অগ্নিসংযোগ, গাড়ি ভাঙচুর, প্রধান বিচারপতির বাসার গেট ও পুলিশের ওপর হামলার কারণে দলটির বহু নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। সেজন্য ৭ নভেম্বর দিবসটি পালনে সভা, সমাবেশ ও মিছিল করা থেকে বিরত থাকছে বিএনপি। গতকাল সোমবার বিকালে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে আত্মগোপনে আছেন বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। এই পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপি এবার ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস উপলক্ষ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করছে না। রুহুল কবির রিজভী আরো বলেন, দলীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ, নেতাকর্মীদের অব্যাহতভাবে গ্রেপ্তারসহ উ™ূ¢ত পরিস্থিতির কারণে ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবসের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। প্রতি বছর এই দিবসে দলের নেতাকর্মীরা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পাশাপাশি দলের পক্ষ থেকে আলোচনাসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এর আগে বিএনপি দুই দফায় তিন ও দুই দিনের অবরোধ কর্মসূচি দেয়। সর্বশেষ গত রোববার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি ছিল। তবে তার আগেই নতুন করে দুই দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দিল বিএনপি। বিএনপির পাশাপাশি, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপিসহ অন্যান্য দল ও জোটও একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে ৭ নভেম্বরকে বিএনপি বলছে, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘আধিপত্যবাদী শক্তির নীলনকশা প্রতিহত করে এ দেশের সিপাহি-জনতা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা’ করেছিল। বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ক্রান্তিকালে শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করেছেন। প্রসঙ্গত, ঐতিহাসিক এ দিবসটি ঘিরে রয়েছে নানা ঘটনা। জড়িয়ে আছে রক্তপাতের ইতিহাস। কাউকে ঝুলতে হয়েছে ফাঁসিতে; প্রাণ দিতে হয়েছে অনেক সৈনিককে। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাত্র ৭৮ দিন পর সেই অশুভ শক্তিই ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে চার জাতীয় নেতাকে। এসবকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা সেনানিবাস। এই প্রেক্ষাপটে ৩ থেকে ৭ নভেম্বর সামরিক বাহিনীর মধ্যে একাধিকবার অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে। একপর্যায়ে গৃহবন্দি হন তৎকালীন চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ওই সব ঘটনায় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। জিয়াউর রহমান প্রথমে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে চলে আসেন। একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়া।