চট্টগ্রামের ৫০ স্পটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পকেটমার চক্র

ঝোঁক বেশি মোবাইল ফোনে

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সংঘবদ্ধ পকেটমার চক্র। নগরীর নির্ধারিত কিছু স্পটে এদের তৎপরতা বেশি। মার্কেটে কিংবা গণপরিবহণে অথবা রিকশায় যাওয়ার পথে টানা পার্টি কবলে পড়ছে মানুষ। ছিনতাইয়ের সময় টান দিয়ে ব্যাগ, স্বর্ণের দুল নিয়ে যায় বলে তারা টানা পার্টি নামে পরিচিত। সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে খোয়াচ্ছেন স্মার্ট ফোন, মানিব্যাগ ও ল্যাপটপসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস। সাধারণ মানুষ বলেছেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। তবে পুলিশ বলছে, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ধরাও পড়ছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা সংঘটিত হলে থানায় অভিযোগ দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ।

ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গণপরিবহণে যাত্রী উঠার সময় গেটের সামনে দেখা যায় জটলা। অনেক সময় অহেতুক ভিড়ও দেখা যায়। যাত্রীদের দুই পাশ থেকে ধাক্কাধাক্কি ও চাপাচাপির পর ভিড় আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন গায়েব করার জন্য এ ধরনের ভিড় সৃষ্টি করে টানা পার্টি বা ছিনতাইকারীরা। ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও খোয়া যাওয়া বা ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন খুব কমই উদ্ধার হয়। এ বিষয়ে থানা পুলিশও খুব বেশি তৎপরতা দেখায় না। সিএমপির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, মাঝেমধ্যে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। পুলিশি তৎপরতায় আবার কমে যায়। বর্তমানে নগরীতে টানা পার্টির দৌরাত্ম্য ও ছিনতাই তৎপরতা অনেকটাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) এলাকার থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি রয়েছে। প্রায় সময় টানা পার্টি ও ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

গোয়েন্দা পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, এলাকা, পাড়া মহল্লা বা রাস্তার পাশে নেশগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে থাকে টানা পার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা। এদের কোনো ঘর বাড়ি নেই। এলাকাভিত্তিক এসব চক্রের স্থানীয় কিছু লিডার থাকে। যারা তাদের বিভিন্ন সময় শেল্টার দিয়ে থাকে। সুযোগ বুঝে তারা ছিনতাই কর্ম চালায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর অন্তত ৫০টি স্পটে এসব ছিঁচকে ঝাপটাবাজদের উৎপাত বেশি। নগরীর ব্যস্ততম নিউমার্কেট মোড়, তিনপোলের মাথা, নতুন স্টেশনের মুখ, পুরোনো স্টেশনের গ্রামীণ মাঠ, রেয়াজউদ্দিন বাজারের মেইন গেট, স্টেশন রোড, টাইগারপাস, দেওয়ানহাট মোড়, আগ্রাবাদ, বাদামতলী মোড়, ইপিজেড, জিইসি মোড়, মুরাদপুর, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব ঝাপটাবাজদের তৎপরতা দেখা যায়। ঝাপটাবাজদের পাশাপাশি নগরীর গণপরিবহণগুলোতে পকেটমারের উৎপাতও বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই লোকজন গণপরিবহণে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ হারাচ্ছেন।

নগরীর বিভিন্ন স্পটে গণপরিবহণের যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। আবার সন্ধ্যার পর বিভিন্ন মার্কেটের সামনে এসব টানা পার্টির উৎপাত বেড়ে যায়। বড় ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় মামলা হলেও ছোটোখাটো ছিনতাই ও ঝাপটাবাজির ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। এতে পার পেয়ে যায় পেশাদার ছিনতাইকারীরা। থানায় খবর নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন শুধু নগরী থেকেই বিপুল পরিমাণ মোবাইল ফোন ছিনতাই হচ্ছে। তবে কী পরিমাণ মোবাইল চুরি কিংবা ছিনতাই হচ্ছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ, সব ক্ষেত্রেই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কিংবা অভিযোগ করেন না ভুক্তভোগী। অনেক ক্ষেত্রে জিডি হওয়ার পরও মোবাইল উদ্ধার করতে পারছে না পুলিশ। কিন্তু কেন এসব মোবাইল উদ্ধার করা যাচ্ছে না, তা নিয়ে পুলিশ জানিয়েছে ভিন্ন বক্তব্য। তারা বলছে, মোবাইল ফোনের আইএমইআই পরিবর্তন করতে চক্রটি তৈরি করেছে একটি ল্যাব। অবৈধভাবে আমদানি করেছে কিছু ডিভাইস। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তারা একটি মোবাইল হ্যান্ডসেটের আইএমইআইটি বদলে ফেলছে। পরে বিক্রি করছে বাজারে। তারা এখন নতুন প্রযুক্তি মাইক্রোস্কোপ, একটি সিপিইউ, দুটি ল্যাপটপ, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল নিয়ে একটি ল্যাব বানিয়েছে। ওই ল্যাবে নিয়ে তারা মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেয়। তারা গ্যারান্টি দেয় যে এটা চোরাই মোবাইল হলেও কেউ ধরতে পারবে না। জানা গেছে, তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কমপক্ষে ৬০ জন পেশাদার পকেটমার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগরী।

প্রতিদিন অফিস ছুটির পর নগরীর বিভিন্ন রুটের বাসে উঠে ভিড়ের মধ্যে এরা হাতিয়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন সেট মানিব্যাগ। তিনটি গ্রুপের মূল নেতা হচ্ছে সাহাবুদ্দিন, ফারুক এবং জাহেদুল ইসলাম ওরফে লিটন। এদের গডফাদার হিসেবে আছে ঢাকার জামাল ওরফে পিচ্চি জামাল নামে একজন। পিচ্চি জামালের হয়ে চট্টগ্রামে এসব পকেটমারদের দলনেতাদের নিয়ন্ত্রণ করে জাহেদ ওরফে ঘাড় বাঁকা জাহেদ। তার বাড়ি বাকলিয়ার ইছাইক্যারপুলে। তবে সে থাকে ঢাকার বাড্ডায়। পিচ্চি জামাল কখনো চট্টগ্রামে আসে না। জাহেদ প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। গত শুক্রবার সকালে পৌঁছায়। বিকালে রেলস্টেশনে গিয়ে ফারুক, সাহাবুদ্দিন, লিটনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতি সপ্তাহে জাহেদ চট্টগ্রাম থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে নিয়ে যায়। পকেটমারদের কেউ গ্রেপ্তার হলে জামাল ও জাহেদ মিলে জামিনসহ ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত হচ্ছে ছিনতাইকারীদের পিক টাইম বা এদের কাজের সময়। তারা এ সময় নগরীর ফ্রিপোর্ট এলাকা থেকে দেওয়ানহাট এবং নিউমার্কেট এলাকার বাসে উঠে পড়ে। উঠেই ভিড়ের মধ্যে মোবাইল এবং মানিব্যাগ পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়। এক বাসে তারা ৭ থেকে ৮ জন একসঙ্গে উঠে। একজন যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে জটলার সৃষ্টি করে। আরেকজন পকেটের নিচ থেকে হালকাভাবে ঘষতে ঘষতে মোবাইলটি উপরের দিকে নিয়ে আসে। তারপর হুট করে নিয়ে পাশে থাকা আরেকজনকে দিয়ে দেয়। সে আরেকজনকে দেয়। এভাবে মোবাইল হাতিয়ে নেয় যাত্রীর পকেট থেকে। এ সময় যদি কেউ ধরা পড়ে, তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তিন চারজন কাজ করে। তারা যাত্রীবেশে থেকে ছিনতাইকারীকে কৌশলে রক্ষা করে।