দ্বন্দ্ব কোন্দল

শ্রমিকদের পাশে নেই জাতীয় শ্রমিক লীগ

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রাহাত হুসাইন

দিন দিন বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। মূল্যবৃদ্ধির আগুনে যেন রীতিমতো জ্বলছে মানুষ। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সংসারের ব্যয়ভার মিটাতে হিমশিম খাচ্ছে দিন মজুরেরা। অস্বাভাবিক দামের কারণে জনজীবনে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও বেশিরভাগ মানুষের আয় বাড়েনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোর দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কর্মসূচি পালন করে আসছে। এর মধ্যে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নেমে পড়েছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে বেতন বাড়ানোর দাবি করছেন তারা। শ্রমিকরা ২৩ হাজার টাকা দাবি করলেও সরকার ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সরকারের নির্ধারিত বেতন কাঠামো মানছে না গামের্ন্ট শ্রমিকদের সংগঠনগুলো। অধিকাংশ সংগঠন সরকারের বেঁধে দেওয়া মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। ১২ হাজার ৫০০ টাকায় সংসার চলবে না। জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে গার্মেন্ট শ্রমিকদের অসন্তোষ ভোটের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ভোটের রাজনীতিতে শ্রমিকরা একটি বিশাল ফ্যাক্টর। ভোটের আগে শ্রমিকদের শান্ত করতে হবে। তাদের স্পন্দন বুঝে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নচেৎ ভোটের রাজনীতিতে বুমেরাং হতে পারে।

শ্রমিকরা যখন বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছে, তখন তাদের পাশে দেখা যাচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতাদের। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এ সংগঠনটি চুপসে গেছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর আন্দোলনে কোথাও দেখা যাচ্ছে না সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। অথচ শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা ও তা বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে জাতীয় শ্রমিক লীগের গঠনতন্ত্রে। শ্রমিকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতি অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না নেতাদের। শ্রমিক লীগের গঠনতন্ত্রে (ড) ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রমিক-কর্মচারী ও মেহেনতি মানুষের জীবনধারণ উপযোগী বেতন, মঞ্জুরী, ভাতা, বোনাস, চাকরির স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা, কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ, সাস্থ্য ও নিরাপত্তা বীমা, বৃদ্ধ বয়সে পেনশন, দুর্ঘটনায় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, গ্রাচুইটি, মৃত্যুর পর পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করার কথা।

জানা গেছে, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে অনৈক্য, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর ঐক্যের বদলে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়েই কালক্ষেপণ করছে জাতীয় শ্রমিক লীগ। ব্যক্তি স্বার্থের দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় শ্রমিক লীগ। বিভক্তির কারণে সাধারণ শ্রমিকদের পক্ষেও কোনো ধরনের ভূমিকা রাখতে পারছে না সংগঠনটি। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলনে ফজলুল হককে সভাপতি এবং কেএম আযম খসরুকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক মন্টু মারা গেলে সভাপতির পদটি শূন্য হওয়ায় জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ-সভাপতি মো. নূর কুতুব আলম মান্নানকে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংগঠন গোছানো দূরের কথা, ৪ বছরে কেটে গেলেও কোনো বর্ধিত সভাও করতে পারেনি সংগঠনটি। আওয়ামী লীগের জাতীয় কর্মসূচিতে অংশ নিলেও দৃশ্যত কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই সংগঠনটির।

গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়কারী আহসান হাবিব বুলবুল বলেন, শ্রমিকদের ন্যায় সংগত আন্দোলনে জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতাদের কখনো রাজপথে দেখিনি। যে কোনো সংকটে তারা শ্রমিক নেতা হিসেবে সামনে হাজির হয়, মালিকরা তাদের শ্রমিক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে তারা মালিকদের স্বার্থে মধ্যস্থাকারী হিসেবে কাজ করেন।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মজুরি বোর্ডের শ্রমিক পক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি সুলতান আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, চাওয়া-পাওয়া মানুষের থাকবেই। এর আগে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ছিল ৮ হাজার টাকা। এখন ৪ হাজার ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। মোট হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া সরকারও গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের প্রতিটি পরিবারকে একটি করে টিসিবি কার্ড দেবে। তখন বাজারের মূল্যের চেয়ে কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারবে। অধিকাংশ গার্মেন্ট শ্রমিকরা সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল বেতন মেনে নিয়েছেন। মালিক পক্ষের দাবি মেনে নেওয়া হয়নি। মালিকরা ১০ হাজার টাকার কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ হাজার ৫০০ টাকা করে দিয়েছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত না মেনে যারা আন্দোলন করছে, তাদের প্রসঙ্গে সুলতান আহমেদ বলেন, কয়েকটি ছোটোখাটো সংগঠন ছাড়া সাধারণ গার্মেন্ট শ্রমিকরা কাজে ফিরে গেছে। যারা আন্দোলন করছে এর পেছেনে কোনো রাজনৈতিক ইন্ধন থাকতে পারে।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবি আদায়ে জাতীয় শ্রমিক লীগ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে কি না- জানতে চাইলে সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমেদ জাতীয় শ্রমিক লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকে বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে শ্রমিকদের স্বার্থে সংগঠন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না সংগঠন বলে অকপটে স্বীকার করেন তিনি।

উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জাতীয় শ্রমিক লীগ বাংলাদেশের একটি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন সঙ্গেও যুক্ত।