নতুন বেতনে সন্তুষ্ট নয় পোশাক শ্রমিকরা

নারী শ্রমিক নিহত কব্জি উড়ে গেল পুলিশের

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বেতন বাড়ানোর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল করছে শ্রমিকরা। এরমধ্যেই গত মঙ্গলবার পোশাক শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম বেতন সাড়ে ১২ হাজার টাকার ঘোষণা করেছে সরকার। ওই বেতনে সন্তুষ্ট হতে পারেনি শ্রমিকরা, সেজন্য বর্ধিত বেতন প্রত্যাখ্যান করে গতকাল রাস্তা অবরোধ করে শ্রমিকরা।

গতকাল মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গাজীপুর। সকাল থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী, জরুন ও বাইমাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। সড়কে কাঠ ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়। যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় শ্রমিকরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। শ্রমিক-পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকদের সংঘর্ষে নারী শ্রমিক আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) নিহত হন। তিনি কোনাবাড়ীর ইসলাম গার্মেন্টে সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কোনাবাড়ী থানার ওসি একেএম আশরাফ উদ্দিন আঞ্জুয়ারার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নাওজোড় এলাকায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের এপিসি কারে এক বিস্ফোরণে কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়। এদের মধ্যে একজনের হাতের কব্জি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম জানান, আহতাবস্থায় পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত পুলিশ সদস্য প্রবীর (৩০), ফুয়াদ (২৮) ও খোরশেদকে (৩০) উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আশিকুল (২৭) ও বিপুলকে (২৪) হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে ফুয়াদের অবস্থা বেশি গুরুতর, তিনি ডান হাতের আঙ্গুল ও কব্জির নিচের অংশে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।

আঞ্জুয়ারার স্বামী জামাল বাদশা দাবি করেন, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গার্মেন্ট শ্রমিকরা বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলনে নামে। এ সময় ইসলাম গার্মেন্টের সামনে পুলিশের গুলিতে তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা ও জালাল গুরুতর আহত হন। সহকর্মীরা তাদের উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতাল পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক আঞ্জুয়ারাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত জালাল জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন। বাদশা আরো বলেন, আমার স্ত্রী ইসলাম গার্মেন্টের কর্মী ছিল। আমরা গাজীপুর কোনাবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। আমাদের এক ছেলে এক মেয়ে আছে। এখন আমার সন্তানদের কে দেখবে।

আন্দোলনরত শ্রমিক, স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ জানান, গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বেতন বাড়ানোর দাবিতে ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন ও বিক্ষোভ করছেন। গত মঙ্গলবার মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর নূ্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তবে এ মজুরিতে শ্রমিক ও তাদের সংগঠন সন্তুষ্ট নন। এর জেরে শ্রমিকরা আন্দোলন ও বিক্ষোভ করেন। পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটে কমপক্ষে ১০ শ্রমিক আহত হয়েছেন। আহতদের উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কোনাবাড়ী পপুলার এবং কোনাবাড়ী ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শিল্প পুলিশ, থানা-পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

কোনাবাড়ি ক্লিনিকের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অনীক বলেন, বেশ কয়েকজন শ্রমিক হাসপাতালে ভর্তি হয়। গুরুতর আহত এক নারী শ্রমিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক থাকায় তাকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন ও বিক্ষোভ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিজিবির লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফিকুল ইসলাম। আন্দোলনরত শ্রমিকরা বলেন, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আমাদের চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ এসে হামলা করেছে। এ সময় আমাদের এক নারী সহকর্মীসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে মোট আটজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে সকালে সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন ও বিকালে নাওজোড় এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচজন আহত হয়েছেন। বিকালে যে পাঁচজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন এদের মধ্যে শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পাশাপাশি এপিসি কারে বিস্ফোরণেও আহত হওয়ার ঘটনা আছে। এখন শ্রমিকরা মহাসড়ক ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হচ্ছে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটনের কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম আশরাফ উদ্দিন বলেন, শ্রমিকরা আঞ্চলিক সড়কগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে রাখে। এছাড়া ভাঙচুরের চেষ্টা করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়।