উচ্ছ্বসিত কক্সবাজারের মানুষ

রেল যোগাযোগে সম্পৃক্ত হচ্ছে পর্যটন রাজধানী

* ঝিনুকের আদলে ছয়তলা আইকনিক স্টেশন * প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন কাল

প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

জাতীয় নির্বাচনের আগে সারা দেশের সাথে রেল যোগাযোগে সম্পৃক্ত হচ্ছে দেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার। এতে স্বপ্নের রেল যোগাযোগের অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে কক্সবাজারবাসীর। আগামীকাল সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুধী সমাবেশ শেষে এই রেলপথে ট্রেন চলাচল ও কক্সবাজার ‘আইকনিক‘ রেলস্টেশন উদ্বোধন করবেন। ছয় তলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্ভলিত ‘ঝিনুকের আদলে’ নির্মিত দেশের একমাত্র ‘আইকনিক’ রেলস্টেশনটির সৌন্দর্য পুরোটাই ফুটে উঠেছে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে পর্যটন শহর কক্সবাজার রেল যোগাযোগে সম্পৃক্ত হওয়ায় উচ্ছ্বসিত সাধারণ মানুষ, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে অনেকটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন কক্সবাজারবাসী। উদ্বোধন শেষে খুব শিগগিরই বাণিজ্যিকভাবে রেল চলাচল শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য মতে, গত ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ রেলওয়ের কারিগরি টিমের কর্মকর্তাসহ পরীক্ষামূলক ট্রেন এসে পৌঁছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নির্মিত কক্সবাজার ‘আইকনিক‘ রেলস্টেশনে। এরপর ১৯ বগি সম্বলিত একটি ট্রেন কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে এসে পৌঁছেছে। আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথে ট্রেন চলাচল ও কক্সবাজার ‘আইকনিক’ রেলস্টেশন উদ্বোধন করে ‘আইকনিক‘ স্টেশন থেকে টিকেট কেটে ট্রেনে করে রামু স্টেশনে যাবেন। রামু থেকে হেলিকপ্টার যোগে মহেশখালীর মাতারবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসমাবেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেলের উদ্বোধন ও প্রথম টার্মিনাল নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি। এছাড়া খুরুশকুল সেতুসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক রেললাইন ও আইকনিক স্টেশন উদ্বোধন উপলক্ষ্যে নেয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানিয়ে রেললাইন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ নানা মেগা-প্রকল্পের ছবি সংবলিত প্লাকার্ড, পেস্টুনে ছেয়ে যাচ্ছে রেললাইন স্টেশনের যাওয়ার সড়কের দুই পাশ ও স্টেশন এলাকা।

স্বাধীনতার পর থেকে কক্সবাজারবাসীর স্বপ্ন ছিল পর্যটন শহরের সাথে সারা দেশের রেল যোগাযোগ সম্পৃক্তকরণ। কক্সবাজারবাসীর আখাক্সক্ষার বাস্তবায়নে ২০১০ সালে সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তব সফলতা এসেছে দ্রুতই। গত ৫ নভেম্বর নতুন রেললাইন হয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এসে পৌঁছে পরিদর্শন ট্রেন। ট্রেন আসার সংবাদ পেয়ে আইকনিক রেলস্টেশনসহ পুরো রেললাইন এলাকায় ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ। প্রথম ট্রেন আসা দেখেই উচ্ছ্বসিত কক্সবাজারের আপামর সাধারণ মানুষ।

স্থানীয় লিংক রোড মুবিনুল হক, জাবেদ, আমিন জানান, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যটন বিকাশের লক্ষ্যে কক্সবাজারবাসীর স্বপ্নের রেললাইন স্থাপনের ঘোষণা দেন এবং বাস্তবায়নও করে দেখিয়েছেন। পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন ‘ঝিনুকের আদলে’ নির্মিত দেশের একমাত্র ‘আইকনিক’ রেলস্টেশন কক্সবাজারে করে দেখিয়েছেন। যার সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন স্থানীয়রা, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে অনেকটা পজিটিভ প্রভাব পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

স্থানিয়রা আরো জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক আগ্রহে কক্সবাজারে লক্ষ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মাঝে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। আগামীকাল এসব মেঘা প্রকল্পসহ ডজনাধিক প্রকল্প উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দৃশ্যমান এসব প্রকল্পের কারণে বদলে যাবে কক্সবাজার। ব্যাপক উন্নয়নের কারণে স্বপ্রণোদিত হয়ে নৌকায় ভোট দিয়ে আবারো আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় নেয়ার পক্ষেই থাকবে কক্সবাজারের সাধারণ মানুষ।

দোহাজারী কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সুবক্তগীন জানান, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার এই নতুন রেললাইনে ট্রেন চলাচলের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে ট্রেন চালিয়ে রেলের পরিদর্শন দপ্তরের টিম এই নতুন রেললাইন ও বিভিন্ন স্টেশন পরিদর্শন করে কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা যাচাই করে দেখেছেন। রেললাইনে কোনো ত্রুটি দেখা যায়নি। আগামীকাল এই রেলপথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করার পর শিগগিরই চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথে বাণিজ্যিকভাবে রেল চলাচল শুরু করা হবে। প্রকল্পটির ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শুধু স্টেশনের ফিনিশিংয়ের কাজ বাকি রয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, কক্সবাজারের সাথে দেশের রাজধানী ও অন্যান্য অঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় কক্সবাজারের পর্যটনের প্রসারের পাশাপাশি মৎস্য, চিংড়ি ও লবণ পরিবহণের পথ সুগম হবে। এছাড়া এই রেলপথ চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমারের সাথে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে সংযুক্ত হবে। এতে চীনের কুনমিং পর্যন্ত রেলপথ চলে যাবে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আগামীকাল সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুধি সমাবেশ শেষে এই রেলপথে ট্রেন চলাচল ও কক্সবাজার ‘আইকনিক’ রেলস্টেশন উদ্বোধন করবেন। কক্সবাজার ‘আইকনিক’ রেলস্টেশন থেকে প্রধানমন্ত্রী টিকিট কেটে ট্রেনে করে রামু স্টেশনে যাবেন। রামু থেকে হেলিকপ্টার যোগে মহেশখালীর মাতারবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চ্যানেলের উদ্বোধন ও প্রথম টার্মিনাল নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রকল্পের আওতায় রেললাইন ছাড়াও কক্সবাজার সদর, রামু, ইসলামাবাদ, ডুলাহাজরা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারীতে মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রকল্পটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কক্সবাজারের ‘আইকনিক’ ঝিনুক আকৃতির স্টেশনটি। ঝিনুক আকৃতির কাচ ঘেরা এ ভবনটি শুধু দেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে সুন্দর রেলস্টেশন। এরই মধ্যে ভবনটির মূল নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ২৯ একর জায়গার ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা ছয়তলা আইকনিক স্টেশন ভবনটিতে থাকছে তারকা মনের হোটেল, শপিং মলসহ অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। ছাদের ওপর বসানো হয়েছে বিদেশ থেকে আনা স্টিলের ক্যানোফি। মূল রেলস্টেশন ভবনের পূর্ব পাশে উড়াল সেতু এবং তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজও প্রায় শেষ হতে চলেছে। যাত্রীদের লাগেজ রাখার ৫০০টি লকার সিস্টেম, আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা, নিচতলায় টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা, দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ, তিন তলায় তারকা মানের হোটেলে অর্ধশতাধিক কক্ষ, সুবিশাল হলরুম, মসজিদ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, চলন্ত সিঁড়ি, এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, আধুনিক বাথরুম। এছাড়া থাকছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ড্রপ এরিয়া, বাস, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস এবং থ্রি হুইলারের জন্য আলাদা পার্কিং এরিয়া। ভবনের সামনের অংশে রয়েছে বিশাল আকৃতির দৃষ্টিনন্দন ঝিনুকের ফোয়ারা। ট্রেন আসার পর যাত্রীরা এই ঝিনুকের ফোয়ারার পাশ দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবেন। তারপর চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে সেতু হয়ে উঠবেন ট্রেনে। স্বপ্নের এই দৃশ্যপট বাস্তবে হাতছানি দেওয়ায় আনন্দে উদ্বেলিত স্থানীয়রা।

২০১০ সালে চট্টগ্রামের-দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেয়া হয়। ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৬ সালে একনেকে অনুমোদিত হয়। ২০১০ সালে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার ও রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। তবে জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালে সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি ৭ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হয়। দোহাজারী-কক্সবাজার-রামু রেলপথ নির্মাণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় এক হাজার ৩৬৫ একর জমি জেলা প্রশাসন কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করছেন।

সারা দেশের সাথে দক্ষিণ চট্টগ্রম ও কক্সবাজার জেলাবাসীর যাতায়াতব্যবস্থা সহজ হওয়ার পাশাপাশি এই রেলপথ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। পর্যটকদের আসা যাওয়া সহজতর হওয়ার পাশাপাশি রেললাইনটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও অভিমত সবার।