ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফের আগুন সন্ত্রাসের পথে বিএনপি-জামায়াত

হরতাল-অবরোধে বাড়ছে আর্থিক ক্ষতি
ফের আগুন সন্ত্রাসের পথে বিএনপি-জামায়াত

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে এলেই বিএনপি-জামায়াত ইসলামের তাণ্ডব শুরু হয় দেশজুড়ে। এবারো নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজপথ। সেই ২০১৩ ও ১৪ সালের মতোই টানা হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর, পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীর ওপর হামলা এবং চলন্ত বাসে অগ্নিসংযোগের দিকে ঝুঁকছে বিএনপি-জামায়াত। এখন তাদের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে মানুষের মাঝে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি-জামায়াতে ইসলাম আগের মতোই সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রাজপথে নেমেছে। তবে মাঠের রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্তা খুব একটা নেই। গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ‘মহাসমাবেশের’ ডাক দেয়া হয়। সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীরা সহিংস হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা। ওই সময়ে এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রাজধানীর কাকরাইলে বাসে আগুন, সাংবাদিক ও প্রধান বিচারপতির বাসভবন লক্ষ্য করে হামলা, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্তত ৭টি গাড়িতে আগুন দেয় তারা। দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের মতো চলতি বছরেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথ উত্তপ্ত রেখেছে বিএনপি-জামায়াতে ইসলাম। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ধাপে ধাপে হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি দিচ্ছে দলটি। দুই দিন বিরতি দিয়ে চতুর্থ দফার আগামীকাল থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অংশগ্রহণের অনিশ্চয়তার মাঝেই এসব কর্মসূচি চলছে। তবে সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই জাতীয় নির্বাচনের অবস্থানে অনড় আওয়ামী লীগ। আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলনে এতদিন খুব একটা সহিংসতা দেখা না গেলেও, বর্তমানে অবরোধকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নাশকতা দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিনই অবরোধের মধ্যে চলছে গাড়িতে আগুন দেয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজপথে আছে পুলিশ। তবে এসবের মধ্যে আতঙ্ক নিয়েই ঘর থেকে বের হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাস আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, তারা (বিএনপি-জামায়াত) আগুনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা উচিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ উদ্যোগে (তাদের প্রতিষ্ঠান) পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সব প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার ভার্চুয়ালি বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আগামীকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টা সড়ক, নৌ ও রেলপথে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে।

রাজনীতি গবেষক ও সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালেও তারা এমন সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত ৯০ দিন হরতাল-অবরোধ করেছে। তখনও তারা সারা দেশে ব্যাপক নৈরাজ্য চালিয়েছে। এবারো তারা একই কাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বিএনপি তার আগের চরিত্রেই ফিরে এসেছে। আগুনসন্ত্রাস ও ভাঙচুরই তাদের সম্বল। সরকারকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন প- করাই বিএনপি-জামায়াতের লক্ষ্য। কারণ তারা জানে নির্বাচনে এলে টিকতে পারবে না। যে কারণে তারা মনে করেছে সহিংসতা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরোধিতা করে বিএনপি-জামায়াত জোট দেশব্যাপী সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগ তাণ্ডব চালায়। ওই সময় বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় মারা যায় অন্তত ১০ জন মানুষ। এছাড়া দোকানপাট, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে আগুন দেয় তারা। নির্বাচনের দিন সহিংসতায় প্রিসাইডিং অফিসারসহ মারা যান কয়েকজন। সারা দেশে ৫৮২টি স্কুলের ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মতে, ২০১৩ সালের নির্বাচন ঘিরে হরতাল-অবরোধে প্রতিদিন দেশের ১৬০০ কোটি টাকা বা জিডিপির ০.২ শতাংশ ক্ষতি হয়। বিগত বছরগুলোর মতো চলতি বছরে দেশে আবারো হরতাল-অবরোধের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। হরতাল ও অবরোধ রাজনৈতিক দাবি আদায়ের কৌশল হলেও দেশের অর্থনীতির জন্য এটি চরম ক্ষতিকর। ১০ বছর আগে ঢাকা চেম্বারের এক গবেষণায় দেখা গেছে- একদিনের হরতালে তখন আর্থিক ক্ষতি হতো ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে অর্থনীতির আকার ৪ গুণ বেড়েছে। ফলে এ সময়ের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ক্ষতিও সেই হারেই বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, হরতাল-অবরোধে বহুমুখী ক্ষতি হয়। এর মধ্যে দিনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিএনপি-জামায়াতের হরতাল ও অবরোধের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, হরতাল কিংবা অবরোধ অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা চাই, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।

বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলের অবরোধে দেশের নানা প্রান্তে গাড়িতে আগুন, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে গত বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি আন্দোলনের নামে ‘সন্ত্রাস করছে’। বিএনপি অবরোধের নামে নৃশংস হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাসের ‘মহোৎসবে’ মেতে উঠেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি শুধু সন্ত্রাস চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের মাধ্যমে তথ্য-সন্ত্রাস অব্যাহত রেখেছে। যার মধ্য দিয়ে তাদের চিরাচরিত মিথ্যাচার-অপপ্রচার ও গুজবের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে।

কাদের বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে ভুলণ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে সামরিক স্বৈরাচার জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উগ্র-সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাস বিএনপির রাজনীতির মূল অস্ত্র। এখন তারা তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের আড়ালে পুনরায় সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপিকে দায়ী করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবর তথাকথিত সমাবেশের নামে বিএনপির সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত তাণ্ডবলীলা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও সংবাদের মাধ্যমে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকার পরও বিএনপির নেতারা নির্লজ্জভাবে মিথ্যাচার করছে। তাদের ক্যাডাররা কীভাবে হাসপাতাল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে, তার প্রমাণও প্রকাশিত হয়েছে।

সাংবাদিকদের ওপর হামলা নিয়েও কাদের বলেন, তাদের (বিএনপি) সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চিত্র ধারণ ও প্রচার করায় তারা গণমাধ্যমকর্মীদের উপরও ন্যক্কারজনকভাবে হামলা চালিয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব চিহ্নিত সন্ত্রাসী রবিউল ইসলাম নয়ন প্রেসের ভেস্ট পরে গাড়িতে আগুন দিয়েছিল, এই অভিযোগ বিএনপির পক্ষ থেকে গোয়েন্দা পুলিশের উপর চাপানোর অপচেষ্টা করা হয়েছিল। তাদের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

বিএনপির ‘বেপরোয়া সন্ত্রাসীবাহিনী’ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপরও হামলা চালিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, তারা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর এবং অসংখ্য যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে। তাদের নারকীয় হামলায় লালমনিরহাটে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম শাহদাত বরণ করেছে, তাদের অগ্নিসন্ত্রাসে একজন নিরীহ পরিবহন শ্রমিক নাইম অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। এছাড়াও সারা দেশে আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে।

জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরিন আখতার বলেন, দেশে বিএনপি-জামায়াত জঙ্গি কায়দায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আগুন সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আগামী ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত