দক্ষিণ চট্টগ্রামে উন্নয়ণের ছোঁয়া

কক্সবাজার-খুরুশকূল সংযোগ সেতুর দ্বার উন্মোচন

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  স্টাফ রিপোটার, কক্সবাজার

আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে বাঁকখালী নদীর ওপর নবনির্মিত ‘কক্সবাজার খুরুশকূল’ সংযোগ সেতুর দ্বার খুলেছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সেতুটি উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে খুরুশকূল আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ প্রস্তাবিত আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ আরো একধাপ এগিয়ে গেল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সেতুটি যোগাযোগ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ‘কক্সবাজার-খুরুশকূল’ সংযোগ সেতুর দুই পাড়ের মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন অবশেষে দৃশ্যমান হলো। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ৩ মিনিটের পথ। তারপরই চোখে পড়বে বাঁকখালী নদীর ওপর নবনির্মিত সবচেয়ে সুন্দর সেতু। আর সেতুটির দুই প্রান্তে নির্মিত নতুন সড়ক। নদীর দুই পাড়ের মানুষের মেলবন্ধন করতে ‘বাঁকখালী সেতুর’ দ্বার খুলছে। সেতু ও আশপাশের এলাকা ঘিরে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন এলাকাবাসী।

খুরুশকূল এলাকার বাসিন্দা এমআর খোকন বলেন, নবনির্মিত এই সেতুর মাধ্যমে আমাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। এখানে আগে রাস্তা ছিল না। ব্যবসা করতে কক্সবাজার শহরে যেতাম নৌকায় চড়ে। আগে খুরুশকূলে জমিজমার দাম কম ছিল। কিন্তু এখন রাস্তা ও সেতু হওয়ায় জমিজমার দাম অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এখন খুরুশকূল এলাকাটিই শহরের মতো হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র এই সেতুটির কারণে। এখন আমরা গাড়িতে চড়ে কক্সবাজার শহরে মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব।

তিনি আরো বলেন, খুরুশকূলে লবণ, চিংড়ি উৎপাদন একই সঙ্গে চাষাবাদ হচ্ছে। এখন এসব নিয়ে আমরা খুব দ্রুতই কক্সবাজার শহরে নিয়ে যেতে পারব আর বিক্রি করতে পারব। যেখানে আগে কক্সবাজার শহরে যেতে আধা ঘণ্টা বা ১ ঘণ্টা লেগে যেত। সেতুটি হওয়ায় সহজেই কক্সবাজার শহরে পৌঁছা যাবে। গতকাল উদ্বোধনের পর সন্ধ্যায় বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত সেতু এলাকা গিয়ে দেখা যায়, পুরো সেতুটি রঙিন করে সাজানো হয়েছে। রং লাগানো হয়েছে। সেতুটি লাইট লাগিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন ছাড়াও পর্যটকরাও সেতুটি এক পলক দেখতে ভিড় করেন।

কস্তুরাঘাট এলাকার বাসিন্দা যুবলীগ নেতা এসএম জসিম উদ্দিন বলেন, কস্তুরাঘাট জায়গাটিতে আগে ময়লা-আবর্জনা ছিল। সেখান থেকে সরকার উন্নয়ন করেছে। বর্তমান সরকার যে সেতুটি নির্মাণ করেছে তা দুই পাড়ের মানুষের যাতায়াতের সংযোগই শুধু ঘটাবে না, দুই পাড়ে তৈরি হবে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা। এছাড়া এখানে খুরুশকূল আশ্রয়ণ প্রকল্প হয়েছে। সেটিও একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন খান বলেন, সেতুটি গত ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এটি নির্মাণে কার্যকাল ছিল ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে নির্মাণ বিলম্বিত হয়েছে। পরে সেতুটি নির্মাণের কার্যকাল নির্ধারণ করা হয় চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তারপরও সেতুটির নির্মাণকাজ গত ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, কক্সবাজার-খুরুশকূল সংযোগ সেতুটির দৈর্ঘ্য ৫৯৫ মিটার। সেতুটি ১১টি স্প্যানের ওপর নির্মিত। এর মধ্যে নদীর মূল অংশে তিনটি ৬৫ মিটারের এবং অপর আটটি ৫০ মিটারে স্প্যান। ডাবল সেল ও ইসি বক্স গার্ডার সম্বলিত নির্মিত সেতুটি ফাইল ক্যাপ পানির স্তর থেকে ৮ মিটার নিচে স্থাপিত হয়েছে। এতে উজান থেকে আসা পলি ও বালিতে ভরাট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় নৌযান চলাচলে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না।

তিনি এ ধরনের বিশেষত্বের এটিই দেশে নির্মিত প্রথম সেতু দাবি করেন। সেতুটি এলজিইডির নিজস্ব নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সেতুটির নকশা বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রেটিং বা পরীক্ষা করা।

তিনি আরো বলেন, ২৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সেতুটির উভয় পাশে ২ হাজার ৭৫০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার অংশে ৯০০ মিটার এবং খুরুশকূল অংশে ১ হাজার ৮৫০ মিটার।

নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন খান আরো বলেন, কক্সবাজার জেলাটা পর্যটন নগরী। সারা বিশ্বের কাছে পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার জেলা। কক্সবাজার শহরের উত্তর পাশে বাঁকখালী নদী প্রবাহমান। এই বাঁকখালী নদীর পাড়েই যেই জায়গাটার মধ্যে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে, যেটা ময়লার ভাগাড় পরিণত ছিল। সেই জায়গায় এখন একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু এলজিইডির মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছে এবং গুণগত মানের বিষয়ে জিরো টলারেন্স রেখে আমরা এই সেতুটি নির্মাণ করেছি। এই সেতুটি নির্মাণের ফলে যে বিষয়টি আমাদের নতুন মাত্রা যোগ করেছে, সেটি হলো পর্যটন শিল্প এবং আরেকটা দিক থেকে কক্সবাজার শহরকে সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে এই সেতুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন খান আরো বলেন, কক্সবাজার শহরের উত্তর দিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এখানে রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সেখানে যারা উদ্বাস্তু হিসেবে ছিলেন তাদেরকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিচ্ছে বর্তমান সরকার। সেক্ষেত্রে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারকে খুরুশকূল প্রান্তে তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারাও এই সেতুটি ব্যবহার করে খুব সহজেই কক্সবাজারে তাদের নিত্যদিনের কার্যক্রম করতে পারবে। মূলত এই উদ্দেশ্যেই এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এই সেতুটি নির্মাণের ফলে নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলার সঙ্গে দূরত্ব কমে যাবে। চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের দূরত্বও অনেক কমে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরটেকের বাসিন্দাদের জন্য বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খুরুশকূলে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণাধীন। প্রথম ধাপে ছয়শ পরিবারকে স্থানান্তর করা হলেও প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর করা হবে। সেখানে যাতায়াতের জন্য বাঁকখালী নদীর উপর সেতু ও ৮ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।