আইকনিক রেলস্টেশনের যাত্রা শুরু

দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার অবসান

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার

কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সংযোগ হওয়ার বিষয়টি গৌরবের বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে রেল-সংযোগ একটি নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। কক্সবাজার জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার অবসান হয়েছে। দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন, এশিয়ান বৃহৎ এবং ঝিনুক আদলে তৈরি আইকনিক রেলস্টেশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজার এখন থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গতকাল বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটের সময় অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদান শুরু করেন।

প্রধানমন্ত্রী সুধীসমাবেশ পৌঁছার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর তিনি শিশুদের সাথে ছবি তুলেন। এর পরই মঞ্চে উঠে বসেন। প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানের আগেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন একটি শুভেচ্ছা স্মারক।

রেলমন্ত্রী ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি নুরুল ইসলাম সুজন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রেলকে আগামী ৩ বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানের করতে কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মাহমারিতে বিনামূল্যে চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। বিশ্বের নানা দেশে যুদ্ধের কারণে কিছু মূল্য বেড়েছে। তাই প্রতিটি মানুষকে খালি জায়গায় খাদ্য উৎপাদন করতে অনুরোধ করেন তিনি।

তিনি বিএনপি ও জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, চোখ থাকতে অন্ধরা উন্নয়ন দেখে না। তাদের পরামর্শ ১০ টাকায় ঢাকায় চক্ষু চিকিৎসা নেয়া। যারা আগুন-সন্ত্রাস করে, আগুন দিয়ে বাস পুড়িয়ে দেয়া, মানুষ হত্যা করে, তাদের চোখ না মনও অন্ধ। তারা ধ্বংস করে, সৃষ্টি করে না। এদের কাছ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, এশিয়ান রেলওয়ের সাথে এটা সংযোগ হবে। এটাকে সঠিক ব্যবহারের অনুরোধ জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাকে নিজের সম্পদ মনে করে ব্যবহার করতে হবে। এটা পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সবার। চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত রেল-সংযোগ হবে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে দেশবাসী ব্যবহারে যত্নবান হবেন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। এটার সাথে থাকতে হবে সবাইকে। রেললাইনের জড়িতদের ধন্যবাদ জানিয়েছে দুপুর ১টায় বক্তব্য প্রদান শেষ দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একে একে রেল বন্ধ করে দেয়া হলো। বলা হলো রেল লাভজনক না। এই রেল সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য। পণ্য পরিবহণের। এটা নিয়ে লাভক্ষতির চিন্তা করা যায় না। এবার সরকার গঠনের পর রেল আলাদা মন্ত্রণালয় করে সেতু মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করা হলো। আলাদা বরাদ্দ করা হলো। ১৫ বছরে ৮৭৩ কিলোমিটার রেললাইন বৃদ্ধি করা হয়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘রেলে কক্সবাজার আসা যাবে। এটা স্বপ্ন। কিন্তু এটা বাস্তবে রূপ নিল। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেল আসছে। পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার আসার উদ্যোগ নেয়া হবে। উত্তর অঞ্চলের সাথে যুক্ত হবে এই লাইন। সরকারপ্রধান কক্সবাজারের পর্যটনের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেয়া এবং রেলে ওয়াইফাই ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়ে বলেন, কেউ বাহির থেকে এসে আমাদের পরামর্শ দেবে, খবরদারি করবে, তা হবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর পরই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থেমে গেছে। অথচ এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ৩ বছর ৭ মাস পরই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল। জাতিসংঘ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ানো যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের কথা স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ১৫ আগস্টের পর বন্দুকের নল দিয়ে ক্ষমতায় এসে কলংকিত ইতিহাস রচিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের দেশে এসে সম্মানিত করা, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে মুছে দেয়ার চেষ্টা চলেছে একে একে। সেই বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে আমার দেশে ফেরা। আমি এদেশের মানুষের জন্য সব কিছু করতে চাই। ক্ষমতার লোভে দেশের সম্পদ বিক্রি করতে রাজি না। আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা।’

দুপুর ১টা ২৩ মিনিটে রেল কাউন্টারে গিয়ে প্রথম টিকিট কাটেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর হেঁটে যান রেলের দিকে। রেলের পাশে দাঁড়িয়ে সবুজ পতাকা নিয়ে নেড়ে বাঁশি বাজিয়ে প্রধানমন্ত্রী রেলে উঠেন। দুপুর ১টা ২৯ মিনিটে রেলটি রামু স্টেশনের দিকে যাত্রা করে। ১২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রী রামু স্টেশনে নেমে যান। তার সাথে রেলটি রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সুধীমহল, শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ছিলেন। দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটের সময় রেল পৌঁছে রামু স্টেশনে। রামু পৌঁছার পর প্রধানমন্ত্রী দুপুরের খাবার ও নামাজের বিরতি নেন। এরপর বিমানবন্দর হয়ে হেলিকপটারযোগে যাত্রা দেন মাতারবাড়ীর জনসভায়। ডিসেম্বরে থেকে বাণিজ্যিকভাবে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলবে : ডিসেম্বরেই ঢাকা থেকে কক্সবাজার এবং কক্সবাজার থেকে ঢাকা রুটে একটি ট্রেন আমরা বাণিজ্যিকভাবে চালাতে পারব বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। গতকাল কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

তবে এখনো সেই ট্রেনের কী নাম হবে, তা ঠিক হয়নি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, রেলের জন্য ছয়টি সম্ভাব্য নাম আমরা আপনার (প্রধানমন্ত্রীর) কাছে পাঠিয়েছি। এই ছয় নামের মধ্যে যেটি আপনার পছন্দ হয়, সেটি পছন্দ করবেন। অথবা আপনি যদি অন্য কোনো নাম দেন, সেটি আমরা রাখব।

রেলমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনি পরামর্শ দিয়েছেন, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার স্থানীয়ভাবে লোকাল বা কমিউটার ট্রেন চালানোর বিষয়ে। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী আমরা আগামী দিনে এ রেল ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাব। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নান্দনিক রেলস্টেশনের উদ্বোধন করেন। একই সময়ে তিনি দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনেরও উদ্বোধন করেন।

প্রসঙ্গত, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে ঝিলংজায় ২৯ একর জমিতে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে চোখধাঁধানো আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। পুরো স্টেশনের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চারপাশে ব্যবহার করা হয়েছে কাঁচ। ছাদের ওপর ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক স্টিল ক্যানোফি। ফলে দিনের বেলা বাড়তি আলো ব্যবহার করতে হবে না স্টেশনে। আর অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলীর কারণেই একে বলা হচ্ছে ‘গ্রিন স্টেশন’।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন গণমাধ্যমকে বলেন, ছয়তলার এই স্টেশনে রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি, মালামাল রাখার লকার, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমলসহ আধুনিক সব সুবিধা। ৪৬ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা সম্বলিত স্টেশনটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। যেখানে আছে কনভেনশন হল, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, এটিএম বুথ, প্রার্থনার স্থানও। স্টেশনে ফুড কোর্ট, হোটেল ও শপিং কমপ্লেক্সের বিষয়টি বাইরের এজেন্সি দ্বারা টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে।

দোহাজারী-কক্সবাজার ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ শুরু হয়ে ২০১৩ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে, ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল একনেকে অনুমোদিত হয় এবং এ লাইনে ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালে সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকায়। এ বাজেটে এডিবি ঋণ দেয় ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা আর বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি ৭ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে।