ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পোশাক শিল্পের নৈরাজ্যের নৈপথ্যে অশুভ শক্তি

পোশাক শিল্পের নৈরাজ্যের নৈপথ্যে অশুভ শক্তি

পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো ৮ হাজার থেকে বৃদ্ধি করে ন্যূনতম ১২ হাজার ৫০০ টাকা করেছে সরকার, যা ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। এরপরও নতুন মজুরি কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে পোশাকশ্রমিক সংগঠনের একাংশ গাজীপুর, মিরপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জে সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করছে। জ্বালাওপোড়াও-ভাঙচুরসহ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করছে। যার কারণে পোশাক কারখানায় কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কারখানার সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে ১৩০টি পোশাক কারখানার সব কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ।

গতকাল পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সহকর্মী নিহতের প্রতিবাদে ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। এর আগে ৮ নভেম্বরে গাজীপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক নারী পোশাক শ্রমিক নিহত হন।

এদিকে গাজীপুরে পোশাক কারখানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা করেছে তুসুকা গ্রুপ। গত শনিবার দিবাগত রাতে কোনাবাড়ী থানায় ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০০ জনকে অভিযুক্ত করে এ মামলা করা হয়। কারখানায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ এনে তুসুকা গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। গতকাল কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেএম আশরাফ উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওসি আরো জানান, আগেও শ্রমিক বিক্ষোভ ও কারখানায় অগ্নিসংযোগ, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় কোনাবাড়ী থানায় মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ৪ হাজারের বেশি শ্রমিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

পোশাক শ্রমিক আন্দোলনের সমন্বয়ক তাসলিমা আখতার বলেন, মজুরি বোর্ড যে প্রহসনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে দিয়েছে, তা দেশের ৪০ লাখ শ্রমিক প্রত্যাখ্যান করেছে। শ্রমিকরা কখনোই ১২ হাজার ৫০০ টাকার প্রস্তাব মেনে নেবে না। মালিকপক্ষ ও সরকার কখনোই শ্রমিকদের মানুষ মনে করে না। পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ বলেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ মজুরি অপ্রতুল। ১২ হাজার ৫০০ টাকায় এখন কোনোভাবেই একজন শ্রমিকের জীবন চলবে না। এই মজুরি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

জানা গেছে, পোশাক খাতে বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেছে। এই শিল্পে কাজ করছেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যার আবার ৮৫ শতাংশই নারী। এই শিল্প প্রসারের কারণেই নারীদের সামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। কর্ম সংস্থানের ক্ষেত্রে দূর হয়েছে সামাজিক বৈষম্য। দেশের বিকাশমান গার্মেন্ট শিল্পকে ধ্বংস করে একটি অশুভ শক্তি দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়ার এক আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। দেশের তৈরি পোশাকশিল্প খাত ধ্বংস হয়ে গেলে জাতীয় বাজেটের অর্ধেকের সমপরিমাণ প্রায় এক-চতুর্থাংশ বিনিয়োগ ও বৈদেশিক আয় বন্ধ হয়ে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পোশাক খাত বিকশিত না হলে দেশ বেকারের বাগাড়ে পরিণত হতো। পোশাক খাত সেই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছে। বিশ্বমন্দার কারণে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক খাতের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা ও তো অস্বীকার করলে চলবে না। এরপরও বেতন বৃদ্ধির যে দাবি পোশাক শ্রমিকরা করেছেন, সেটি মেনে নিয়েছেন কারখানার মালিকরা। এরপরও বাংলাদেশের প্রধান রপ্তনি খাত পোশাক শিল্প শ্রমিকদের বেতনভাতা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে, সেটি কেবল শ্রমিক অসন্তোষ নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কিছু অপশক্তি সুযোগ খুঁজছে। কেন না, পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিকের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, সহিংস ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ কখনো মেনে নেয়া যায় না।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতের মজুরি কয়েকটি দেশের মজুরির সাথে তুলনা করে শ্রমিক নেতারা প্রায়শই যে চিত্রটি তুলে ধরেন, তা অপাতদৃষ্টিতে বেশ তারতম্য মনে হলেও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা যুক্তিযুক্ত নয়। কেন না, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি কারখানার সক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি অন্যান্য দেশের চেয়ে কম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের সক্ষমতা। সক্ষমতার দিক থেকে আমাদের দেশের শ্রমিকরা অনেক পিছিয়ে। ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা তিন ভাগের দুইভাগ মাত্র। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা না বাড়িয়ে শুধু মজুরি বৃদ্ধি করলেই চলবে না।

এ বিষয়ে গতকাল বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মজুরি বৃদ্ধির পরও আন্দোলনের নামে বিভিন্ন জায়গায় কারখানা ভাঙচুর করা হচ্ছে। মজুরি ঘোষণার পর থেকে বেশ কয়েকটি কারখানায় অজ্ঞাতনামা কিছু উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক অযৌক্তিক দাবিতে বেআইনিভাবে কর্মবিরতি পালন করে কর্মকর্তাদের মারধর করেছে। কারখানার ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। উ™ূ¢ত পরিস্থিতিতে আশুলিয়া, কাশিমপুর, মিরপুর ও কোনাবাড়ী এলাকার প্রায় ১৩০টি পোশাক কারখানা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব কারখানার মালিকরা মূলত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কারখানার সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেসব কারখানা শ্রমিকরা কাজ করতে আগ্রহী, সেগুলোতে কাজ চলছে। তাদের কাজ চলমান থাকবে।

তিনি বলেন, করোনা মহামারিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে বন্ধ হওয়া কারখানার সংখ্যা ৩১৭টি। করোনা-পরবর্তী সময়ে অন্য কারণে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে না পারার কারণে ২৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। শিল্পের উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্ধ কারখানার সংখ্যাও বাড়ছে। কারখানা বন্ধ হয়েছে নানান সংকটে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার ৮৮৫টি পোশাক কারখানা বিজিএমইএ‘র সদস্যপদ গ্রহণ করলেও কালের পরিক্রমায় ৩ হাজার ৯৬৪টি সদস্য কারখানা বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।

পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির পরও বিভিন্ন শিল্প এলাকায় কিছুসংখ্যক শ্রমিক পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। তবে অধিকাংশ শ্রমিক সরকারঘোষিত মজুরি মেনে কাজে যোগদান করলেও কিছুসংখ্যাক নামধারী শ্রমিক এই ইস্যুটি জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে। তারা রাজপথে গাড়ি ভাঙচুর, অরাজকতা ও কারকাখানায় ভাঙচুর চালিয়ে কর্মরত শ্রমিকদের কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণ পোশাক শ্রমিদের ইতিবাচক পদক্ষেপে বিশৃঙ্খলাকারীরা বেশিদূর এগোতে পারবে না।

পোশাক খাতে ধ্বংসের পাঁয়তারায় লিপ্ত তাদের চিহ্নিত করতে হবে শ্রমিকদেরকেই। তবে সাধারণ শ্রমিকদের কথা হলো, যারা মাঝেমধ্যেই গার্মেন্ট সেক্টরে এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হয়, তাদের অনেকেই নাকি গার্মেন্ট শ্রমিক নয়। এরা বেশিরভাগই বহিরাগত।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যৌথ সভায় গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পোশাক কারখানায় শ্রমিক আন্দোলনে স্পষ্টত বিএনপি ও তার দোসরদের কালো হাত আছে। উসকানি ও গুজবে নিরীহ শ্রমিকদের বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রমিকদের অধিকাংশ দাবি সমাধান হয়ে গেছে। বাকিটা সমাধানে শ্রমিকরা এগিয়ে আসবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি মনিটরিং করছেন।

শ্রমিকদের কাজে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকরা নিজেদের ক্ষতি নিজেরা করবে না। শ্রমিকরা বিভ্রান্ত হলে ক্ষতিটা দেশের এবং শ্রমিকের নিজের হবে। গুজব রটনাকারীদের ক্ষতি হবে না।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার বিষয়টি রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে। বিশ্বের অন্তত ৯০টি দেশে ন্যূনতম মজুরি আইন করে নির্ধারণ করা হয়। ন্যূনতম মজুরি আইন প্রথম করা হয় নিউজিল্যান্ডে ১৮৯৬ সালে। এর পর অস্ট্রেলিয়ায় ১৮৯৯ সালে, ব্রিটেনে ১৯০৯ সালে, শ্রীলঙ্কায় ১৯২৭ সালে এবং ১৯৩৬ সালে ভারতে, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তন করা হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, স্পেন, মরিশাস, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে প্রতি বছর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়। কানাডায় করা হয় প্রতি ২ বছর পর পর। বাংলাদেশে ৫ বছর পর পর মজুরি পুনর্নির্ধারণের আইন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত