ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

না অবরোধ না হরতাল

কোন ধরনের কর্মসূচি পালন করল বিএনপি

বাসে আগুন দেয়ার মধ্যে ছিল ‘সাফল্য’
কোন ধরনের কর্মসূচি পালন করল বিএনপি

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অঙ্গীকার করে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে মাঠে রয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তাদের এই দাবি আদায়ে তারা হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করছে। এরই মধ্যে বিএনপি ও সমমনাদলগুলো চতুর্থ দফার অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। তবে তাদের এই অবরোধ ও হরতাল কর্মসুচি পালনের মধ্যদিয়ে তারা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। হরতাল চলাকালে সব অফিস আদালত, ব্যাংক-বিমা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। তবে বিএনপির জ্বালাওপোড়াও কর্মসূচির ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। ঢাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও দূরপাল্লার যান চলেছে কম। হরতালের ডাক দিয়ে বিএনপির নেতারা ঘরে বসে থেকেছেন। হরতাল কর্মসূচি পালনের দায়িত্ব পড়ে কর্মীদের ওপর। বিএনপির কর্মীরা হরতাল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সরর উপস্থিতি হরতাল আহ্বানকারীদের বিপাকে ফেলে। আওয়ামী লীগ উন্নয়ন ও শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়ে রাজপথে থাকায় বিএনপি ও তাদের সমমনাদলগুলো আন্দোলনের মাঠে টিকে থাকতে পারেনি। হরতালের স্বাদ মিটিয়ে বিএনপি অবরোধ কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়ে চতুর্থ দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ডেকে আজ সকাল ৬টায় তা শেষ করল। এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জাতীয় নেতারা যেভাবে পুলিশের হাতে হেনেস্তা হয়েছেন, সরকার পতনের ডাক দিয়ে বিএনপির নেতাদের তেমন কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়নি। তারা অনেকটা অনায়াসে রাজপথ ছেড়ে যাওয়ায় দাবি আদায়ে সরকারের ওপর তেমন চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি।

কোনো দলীয় সরকারের অধীনে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দিয়ে সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি আদায়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। এ লক্ষ্যে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশেল ডাক দেয় তারা। মহাসমাবেশে হামলা, নেতাকর্মীদের হত্যা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি-হয়রানি ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গত ২৯ অক্টোবর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এরপর চার ধাপে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে দলটি। তবে প্রশ্ন হচ্ছে- হরতাল ও অবরোধের নামে বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো কী কর্মসূচি পালন করল তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। রাজনেতিক দাবি আদায়ে হরতাল নাকি অবরোধ- কোনটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর কর্মসূচি এ প্রশ্নটি এখন সাধারণ মানুষের। জনগণ বিগত দিনে বিএনপির হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে কোনো প্রার্থক্য নির্ণয় করতে পারেনি। অন্য স্বাভাবিক দিনগুলোর মতো ওই সব দিন দেশবাসী অতিবাহিত করেছে। হরতালে বিএনপি কোনো প্রভাব ফেলতে না পারলেও অবরোধ কর্মসূচি ডেকে তারা কয়েকটি বাসে আগুন দিয়েছে। এটাই তাদের আন্দোলনের ‘সাফল্য’ বলে মনে করা হচ্ছে। দাবি আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল বা অবরোধের ডাক দিয়ে থাকে। হরতাল-অবরোধকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করার চেষ্টা করে রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারও পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল রাজধানীতে মহাসমাবেশ করে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কর্মীসমর্থক জড়ো করতেও সফল হয় বিএনপি। তবে মহাসমাবেশ শুরুর আগেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিএনপির কর্মীরা। প- হয়ে যায় তাদের মহাসমাবেশ। মহাসমাবেশ করতে না পেরে পরদিন ২৯ অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচির ডাক দেয় বিএনপি। হরতাল শেষ হতে না হতেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। দলটি হরতাল ছেড়ে কেন অবরোধ কর্মসূচিতে আসল। হরতাল আর অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে পার্থক্য কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, হরতাল হচ্ছে : গাড়ির চাকা ঘুরবে না, অফিস-আদালত খুলবে না। দোকানপাট, স্কুল কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এক কথায় সব কিছু অচল করে দেওয়ার কর্মসূচি হচ্ছে হরতাল। বাস্তবে কি সেই দিন হরতাল কর্মসূচি হরতালের মতো পালিত হয়েছে। সবই তো সচল ছিল। সব কিছু অচল করে দেয়ার ডাক দিয়ে বিএনপিতো জনগণকে রজপথের নামাতে পারেনি। কর্মজীবিদের কাজে যেতে বাধা দিতে পারেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে পারেনি। জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্থ করতে পারেনি। তাহলে এটা কেমন হরতাল?

অন্যদিকে, অবরোধ কর্মসূচি অর্থ হচ্ছে; সব কিছু খোলা থাকবে। অথচ যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে। গণমাধ্যম, ফায়ার সার্ভিস, চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ জরুরি সেবাগুলো ছাড়া আর সব ধরনের সরবরাহ চেইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে অবরোধ কর্মসূচির মাধ্যমে। এক শহর থেকে আরেক শহরে কিংবা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় পরিবহণ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করাটাকে অবরোধ বলা হচ্ছে। সরকারবিরোধীরা জ্বালাওপোড়াওয়ের মাধ্যমে মানুষকে অবরোধ কর্মসূচি পালনে বাধ্য করে থাকে। জনগণ হরতালের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিক বা না দিক; সড়ক, নৌ ও রেলপথে বাধা দিয়ে কর্মসূচি পালনে মানুষকে বাধ্য করা হয়। হরতাল মানে সবকিছু বন্ধ। এ কর্মসূচিতে সমাবেশ নাও হতে পারে। আর অবরোধের সময় রাজপথ, রেলপথ সব বন্ধ থাকারই কথা। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ছাড়াও ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষদের উপস্থিতির বিষয়টাও অবরোধ কর্মসূচিতে থাকে। এটা করা হয়ে থাকে সরকারকে বাধ্য করার জন্য। তবে বিএনপির হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি একই রূপ ধারণ করায় একটা নতুন রূপ দেখতে পেল দেশের মানুষ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ রাজপথে উন্নয়ন ও শান্তি সমাবেশ ডেকে রাজপথে ছিল। ফলে অবরোধকারীরা কোনো প্রকার নৈরাজ্য করার সুযোগ পায়নি। এবারের হরতাল-অবরোধে ঢাকাসহ সারাদেশে জীবনযাপন ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক ছিল যানবাহন চলাচল। স্বাভাবিক কাজকর্ম চলতে থাকে অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের পাশাপাশি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি পালন না করতে পেরেছে অবরোধ কর্মসূচি, না করতে পেরেছে হরতাল। তাহলে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করল বিএনপি- এমন প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে নামে বিএনপি। তখন টানা ৩ মাসের আন্দোলন করে দলটি। ওই সময়ের ঘোষিত অবরোধ আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি না টেনেই নতুন করে চার দফায় অবরোধ কর্মসূচি শেষ করল বিএনপি।

বিএনপি নেতারা বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত টানা কর্মসূচি থাকবে। তফসিল ঘোষণা করা হলে আরো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে। তারা বলছেন, সেটা হতে পারে অসহযোগ আন্দোলন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অসহযোগ আন্দোলন কে কার বিরুদ্ধে করে সেটি বিএনপির নেতারা হয়তো ভেবে দেখেননি। একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কীভাবে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলবে বিএনপি? বিএনপিতে কি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন মহান নেতা আছেন? বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে দেশকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ কর্তৃক পরিচালিত এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। ১ মার্চে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার পর জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ২ মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলমান থাকে। মোট ২৫ দিন স্থায়ী হয় এই আন্দোলন।

আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। এই সময়কালে ক্রমশ পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের ওপর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। আন্দোলনের একপর্যায়ে সেনানিবাসের বাইরে পুরো পূর্ব পাকিস্তান কার্যত শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বেগম খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের পক্ষে লন্ডন থেকে দেশে অসহযোগ অন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া কী সম্ভব? বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার চিন্তা করছে দলটি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে এর আগে অবরোধ ডেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি কেন? বিএনপির গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার মতো শক্তি নেই- মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এ কারণেই তারা বরাবরের মতো অগ্নিসন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে।’ আওয়ামী লীগ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর জানিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির যে কোনো ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এবং সন্ত্রাস, নাশকতা, নৈরাজ্য ও গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হরতাল অবরোধ থাকবে কিন্তু বিএনপি যে অবরোধের নামে গাড়ি ভাঙচুর, পেট্রল দিয়ে আগুন ধরানোসহ মানুষকে হত্যা করে, এটা কোনো রাজনীতির ভেতর পড়ে না। বরং এটা হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করা হবে। তিনি আরো বলেন, বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বিএনপির অবরোধে আর ভয় না পেয়ে দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল করছে। এতে জনসাধারণের মনের আতঙ্ক কমছে। বিএনপি আজকের দিন বাদ দিয়ে আগামীকাল সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত আবার পঞ্চম দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। এই অবরোধ কর্মসূচিও যদি বিগত দিনের মতো চরিত্র পায়, তাহলে সেই কর্মসূচি কোনো নতুন মাত্রা পাবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত