রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা

হচ্ছে না শর্তহীন সংলাপ নিষ্ফল যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি

* সংলাপের সুযোগ নেই : কাদের * অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি সমীচীন নয় : কূটনৈতিক বিশ্লেষক

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। অভ্যন্তরীণ টানাপোড়নে থাকা প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে শর্তহীন সংলাপে বসার তাগিদ দিয়ে চিঠি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে দলগুলো শর্তহীন আলোচনায় বসতে রাজি নয়, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর চিঠি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

গ্রেপ্তারের আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছিলেন, তাদের তত্ত্বাবধায়কের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা এলেই কেবল যে কোনো ধরনের সংলাপ হতে পারে, নইলে নয়। এরপর সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো শর্ত না থাকলে তারা বসতে রাজি। বিএনপি, জামায়াত ও সমমনা দলগুলো এই মুহূর্তে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে। আর সরকারের অবস্থান হলো, উচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হওয়া এই সরকারব্যবস্থা ফেরানোর সুযোগ নেই। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্তহীন সংলাপের চিঠি কার্যত অনেকটা ‘নিষ্ফল’ হয়ে গেল।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটা টানাপোড়েন চলছে, এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির উদ্দেশ্যে চিঠি পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। গত সোমবার ওই চিঠি পেয়েছে বিএনপি। চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ওই দিন চিঠি নিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সরাসরি গিয়েছেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কাছে তিনি চিঠিটি হস্তান্তর করেন। এরপর জাপার নেতাদের সঙ্গে পৌনে ১ ঘণ্টা বৈঠকও করেন তিনি। আর গতকাল বুধবার সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি হস্তান্তর করেছেন পিটার হাস।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কেউ যদি ভাবেন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে থাকবে কিংবা সহায়তা করবে, সেটি ভুল ভাবনা। কোনো দেশের রাজনীতি নিয়ে সরাসরি বিদেশি কারো ওপর নির্ভরতা জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আসবে না। গত কয়েক মাসে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সীমাহীন দৌড়ঝাঁপ, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে অব্যাহত ধরণা প্রমাণ করে, মুখে যা-ই বলুক, দেশটি আসলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছে। পিটার হাসের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে কূটনীতিকদের জন্য অবশ্য পালনীয় ভিয়েনা কনভেনশনকে তোয়াক্কাই করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ভয় দেখিয়ে কাজ করতে চাইছে; সেখানে তারা সফল হবে না। ভিসানীতি নিয়ে কী হবে, কার জন্য, আর কে যাবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতির ওপর সূক্ষ্ম হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, যদি কোনো রাজনৈতিক দল মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সহায়তা করবে, সেটি ভুল ভাবনা এবং এর মাধ্যমে জনগণকে অসম্মান করা হয়। সমস্যা থাকলে নিজেরাই সমাধান করা উচিত।

তিনি আরো বলেন, বিরোধী দলের অনেকে মনে করেন পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা তাদের সহায়তা করবে এবং তাদের ভূমিকা মুখ্য এটা তো পরিষ্কার। জনগণের বিশাল ভূমিকা আছে; সেখানে কোনো একটি দল বিদেশিদের ওপর তাকিয়ে থাকে, বিদেশিদের কথাবার্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাহলে জনগণ মনে করবে আমাদের নিচু মনে করা হচ্ছে, আমাদের বিশ্বাস করা হচ্ছে না।

পিটার হাসের অযাচিত দৌড়ঝাঁপে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠি পৌঁছে দেয়া হয়। চিঠিতে সংলাপে বসার কথা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ভিসানীতি প্রয়োগের ব্যাপারেও কথা বলা হয়েছে।

গতকাল সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কাছে ডোনাল্ড লুর চিঠি হস্তান্তর শেষে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। দেশে চলমান সহিংসতা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবগত।

এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সংলাপের চিঠি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব। দলের সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। নিঃশর্ত সংলাপের আলোচনা বিএনপিকে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তারা শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। যেকোনো সময় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে জানতে পেরেছি। সুতরাং, সময় পেরিয়ে গেছে। সংলাপ হলে কাউকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। এই সময়ে সংলাপ সম্ভব কি না, সেটাই বিষয়।

এর আগে পিটার হাসের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বৈঠক শেষে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাপার চেয়ারম্যানকে দেওয়ার জন্য একটি চিঠি নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এসেছিলেন। উনি বলেছেন একই চিঠি বাংলাদেশের তিন দলকে (আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি) দেওয়া হচ্ছে। সেই চিঠির সারসংক্ষেপ হচ্ছে, - যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়।

চুন্নু বলেন, মূলত চিঠিটি হস্তান্তর করতেই পিটার হাস এসেছিলেন। এরপরও তিনি আসার পরে তার সঙ্গে জাপার নেতারা বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচনে যাব কি যাব না, তা এখনো বলিনি। আমরা এখনো অপেক্ষা করছি, সরকার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করবে। যে পরিবেশে মানুষ ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে।

প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ বাড়ে। ২০১৪ সালে মাঠের রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণায় রাজধানীসহ সারাদেশে সহিংসতা দেখা দিয়েছিল। তখনও নানা তৎপরতায় মেতেছিলেন ঢাকার ওই সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। তবে ঠেকাতে পারেননি নির্বাচন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ইসলামী নির্বাচনে এলেও আগের রাতে ভোটে হয়ে যাওয়ার অভিযোগ এনে তত্ত্বাবধায়কের দাবি তোলে। তত্ত্বাবধায়কের দাবিটি বিএনপি-জামায়াত ইসলামীসহ এখনো আন্দোলন করছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। আর ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ১০৩টি।