ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ

বড় একা হয়ে যাচ্ছে বিএনপি

বড় একা হয়ে যাচ্ছে বিএনপি

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ছাড়া সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলই অংশ নিতে যাচ্ছে। তপশিল জমা দেয়ার দিনক্ষণ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নতুন নতুন জোট গঠন করে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিচ্ছে। ছোটোখাটো রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মধ্যে জোট করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিএনপি থেকে হয়ে তৃণমূলের ব্যানারে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন ওই দলের নেতারা। আবার বিএনপির জোট ছেড়ে নিজস্ব জোট গঠন করে বাংলাদেশের কল্যাণ পার্টি ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তারাও ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে আইনি কারণে জামায়াতে ইসলাম নির্বাচনি দৌড়ে অংশ নিতে পারছে না। কার্যত বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃতাধীন মূল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এটা অনেকটাই চূড়ান্ত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। বিএনপির যেসব নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী তারা তারেক জিয়ার হুমকিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দিতে সাহস পাচ্ছেন না। তবে বিএনপির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির মধ্যে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী তারা তৃণমূলের হয়ে কিংবা ব্যক্তিগত ইমেজকে কাজে লাগিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বহিষ্কার করা হতে পারে, এমন ঝুঁকি নিয়েই তারা জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। নির্বাচনে অংশ না নিলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ধামাচাপা পড়ে যায়। ভোটার হারিয়ে যায়। ভোটারের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যান নেতারাও। বিএনপি ষ ১ম পৃষ্ঠার পর

২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ২০১৮ সালে নির্বাচনে মনে প্রাণ অংশ নেয়নি। মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে লন্ডন থেকে তারেক জিয়া যেভাবে ছড়ি ঘুড়িয়েছেন, তাতে কেন্দ্রীয় নেতারা নাখোশ হয়েছেন। এবারও সেই দিকে যাচ্ছে রাজপথের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। লন্ডনে বসে তারেক জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করায় দলের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠা জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সন্তান হওয়ার কারণে তারেক জিয়া দলের শীর্ষ পদ ধারণ করলেও তার মধ্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব রয়েছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি ঘর সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি রাজনীতির তলানিতে পড়ে যাবে। বিএনপির জোট ভাঙা, জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামকে সঙ্গে না পাওয়া এবং জোটের শরীক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি বড় একা হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি যেসব, রাজনৈতিক দলকে মাঠে পেয়েছিল তারা পিছুটান দিয়েছে। বিএনপি জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করতে ধারাবাহিকভাবে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে মাঠে টিকতে পারছে না।

বক্ষিপ্তভাবে কোথায় কোথাও আগুন দিয়ে খবরের শিরোনাম হলেও তা আর কত দিন। অর্থের বিনিময়ে মাদকাসক্ত যুবকরা যানবাহনে আগুন দিলেও তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কতদিন টিকে থাকতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি কার্যত বড় একা হয়ে গেল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল। তাদের মতামত হচ্ছে- বিএনপির পক্ষে নির্বাচন প্রতিহত করার মতো শক্তি ও সাহস নেই। বিদেশি শক্তিও অনেকটা পিছুটান দিয়েছে। বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসলে জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকত। তারা তাদের বক্তব্য জাতীয় সসদে তুলে ধরতে পারত। তবে নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপি সেই সুযোগটি হারাবে। একের পর এক বিএনপি নেতারা দল থেকে বের হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঘোষণা দিচ্ছে অনেক আগে থেকেই ।

সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধিত প্রায় সব দল আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এখন বিএনপির সঙ্গে হাতে গোনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভোট বর্জনের কথা জানালেও শেষ পর্যন্ত তারাও বিএনপি ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নিবে এমন ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিএনপি জানিয়েছে, তারা কোনোভাবে বর্তমান সরকার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। বিএনপির জোট সঙ্গী জামায়াত নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিলেও জাময়াতের নিবন্ধন নেই। বিএনপি জোট ছেড়ে নিবন্ধিত দলগুলো এখন নির্বাচনমুখী।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে আসা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি জোটগতভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তিনটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে নতুন জোট নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে কল্যাণ পার্টি।

বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া মানে ‘আত্মহত্যা’ করা, অতীতে এমন মন্তব্য করেছিলেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক। দীর্ঘদিন ধরে বিরোধিতা করলেও হঠাৎ কেন নির্বাচনের সিদ্ধান্ত, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এবং আমার নেতাকর্মীরা কষ্ট করে রাজনীতিটাকে টিকিয়ে রেখেছি। আমাদের টিকে থাকার একটা সীমা আছে। সেই সীমা আমরা ধরে রেখেছি। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে রাজনৈতিক অক্ষমতা হলো, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আর পেরে উঠছি না।

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে- নিশ্চুপ থাকব, নাকি বিকল্প পন্থা অবলম্বন করব। গত ২৮ অক্টোবরের পর এটা একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই বিকল্পপন্থা নিলাম। কারণ, আমি যে কথাগুলো বলার চেষ্টা করি, সেটা সংসদে বলব।

তিনি বলেন, আমরা আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত হয়েছি। যুক্তফ্রন্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নেবে। এর জন্য আমরা একটি বড় ঝুঁকি নিচ্ছি। অতীতেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে বড়-ছোট দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।

যুক্তফ্রন্ট কী আশঙ্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আশঙ্কার উত্তর হলো, সরকার ওয়াদা করেছে ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনকে জাতির সামনে এবং বিশ্বের সামনে গ্রহণযোগ্য করবে। আমরা এতদিন দাবি করেছিলাম, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবো না। তার উত্তর, দাবি আদায়ে সফল না হয়ে বিকল্প পন্থায় নির্বাচনে অবদান রাখার সুযোগ নিচ্ছি। যুক্তফ্রন্টের জোটে দলগুলো হলো বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (হাতঘড়ি প্রতীক), বাংলাদেশ মুসলীম লীগ- বিএমএল (হাতপাঞ্জা) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল প্রতীক)।

এর আগে আওয়ামী লীগ ঘরানার ১৫টি রাজনৈতিক দলের মোর্চা ‘প্রগতিশীল ইসলামী জোট নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়। চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালের নেতৃত্বে এই মোর্চা আত্মপ্রকাশ করে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোর্চাটি। তৃণমূল বিএনপির ‘সোনালি আঁশ’ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেবে প্রগতিশীল ইসলামী জোট। এছাড়া বিএনপি ছেড়ে আসা তৃণমূল বিএনপির নেতারা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রেখে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পার্টি চেয়ারম্যানের নির্দেশে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল মাধ্যম থেকে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি যে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে। ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।

তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আমরা আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। চুন্নু বলেন, ৩০০ আসনেই নির্বাচন করবে জাতীয় পার্টি। প্রতিটি আসনেই একাধিক আগ্রহী প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছেন। আমরা আমাদের ঘোষণা অনুযায়ী এককভাবেই নির্বাচন করব। আমরা কারো সাথে আসন সমঝোতায় যাব না। জাতীয় পার্টি স্বচ্ছ রাজনীতি করে, জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অপবাদ নেই।

এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আগামী ২৭ নভেম্বর বৈঠকের সময় চেয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। ই-মেইলের মাধ্যমে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি সিইসির কাছে বৈঠকের সময় চেয়ে মেইল করেছেন। ই-মেইলে হোয়াইটলি সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এর আগে মতবিনিময় করায় ইসিকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশনের বর্তমান কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে আপনার দপ্তরে একটি সভায় অংশ নিতে সুযোগ চাই।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও তপশিল পেছানোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন কীভাবে হবে সেটি নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার।

নির্বাচন সম্পন্ন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। এই সময়সীমার ভেতরে ভোট সম্পন্ন করতে হবে। এমতাবস্থায় নির্বাচন কমিশন ভোট কিছু দিন পেছানো দরকার মনে করলে সেটি তারা করতে পারে। এখানে আওয়ামী লীগ বা সরকারের কিছু বলার নেই।

স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে সরকার আইনগত কাঠামো দিয়েছে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, সংসদীয় আইনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় আইনের সংস্কার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিএনপি আসবে না বলেই নির্বাচন একতরফা হবে, এটা ঠিক নয়, অনেকেই নির্বাচনে অংশ নেবে। কারো নির্বাচনে আসা না আসা এটা গণতান্ত্রিক ব্যাপার।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ পেছানোর সুযোগ বিবেচনায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি করানো আমাদের দায়িত্ব নয়। এটা রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব বা যারা প্রার্থী হবেন তাদের দায়িত্ব। আমরা সংবিধান মেনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করব।

বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি বড় দল অনুপস্থিত রয়েছে। যদি তারা নির্বাচনে আসতে চায়, তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত