ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য

দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে এলেই বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়। নির্বাচন কমিশন, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন মিশনের রাষ্ট্রদূতরা। সেই একই ধারায় এবারো কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এরপরেই নির্বাচন নিয়ে রাষ্ট্রদূতদের আলোচনার মাত্রা ভিন্ন আঙ্গিকের পরিণত হয়েছে।

বিদেশি কূটনীতিকদের নড়াচড়ায় বক্তব্য রাখছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও। দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ‘বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া রাজনৈতিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ’ বলে তারা অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে ‘কোনো ক্ষমতাধর দেশেরও কিছু করার নেই’ বলে আওয়ামী লীগ নেতারা মন্তব্য করেছেন। অবশ্য বিদেশিদের এই তৎপরতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা পক্ষে-বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

বাংলাদেশের গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা গেছে, নির্বাচনের এক থেকে দেড় বছর আগে বিভিন্ন বিদেশি দূতরা নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন ইস্যুতে আলোচনা করে। রাজনীতিকদের সৌজন্যে ডিনারেরও আয়োজন করতে দেখা যায় প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের। এবারো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর আগে সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর কূটনীতিকদের তৎপরতা জোরদার হয়েছে।

বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত ও চীনের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্র দুটি নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা না বললেও যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কূটনীতিকরা নির্বাচন নিয়ে সরব রয়েছেন। ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করছেন। একইসঙ্গে রাশিয়ার কূটনীতিকরাও মাঝে মাঝে মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন।

গত বুধবার নিজ দেশে এক ব্রিফিংয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক (এফএমএ) মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, পিটার হাস সরকারবিরোধী মহাসমাবেশ আয়োজনে বিরোধীদলের সঙ্গে পরিকল্পনা করেছেন। এছাড়া বিদেশি কারো সহায়তা ছাড়াই বাংলাদেশের ‘বৈধ নির্বাচনের’ সক্ষমতা আছে বলে মনে করে রাশিয়া। তারা বলছে, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ভিয়েনা কনভেনশনের বিরোধী।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিরোধী দলের এক নেতার সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক করেছেন বলেও দাবি করেছেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। জাখারোভা বলেন, দেশটির আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে ‘স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ করার ছদ্মাবরণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত করার ক্ষেত্র যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রচেষ্টার বিষয় আমরা অব্যাহতভাবে তুলে ধরে আসছি। আমাদের কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদেশি ‘শুভাকাঙ্ক্ষীদের’ সহায়তা ছাড়াই জাতীয় শাসনতন্ত্রের বিধানমতো ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখের সংসদ নির্বাচন স্বাধীনভাবে আয়োজনের সক্ষমতা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের আছে।

অক্টোবরের শেষে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সরকারবিরোধী বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিরোধীদলীয় এক সদস্যের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলেও দাবি করা হয় এই ব্রিফিংয়ে। হাসের এই কার্যক্রমকে ভিয়েনা কনভেনশন না মেনে সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নির্জলা হস্তক্ষেপ’ হিসাবেও তুলে ধরেন রুশ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান নতুন নয়। গত বছরের শেষ দিকে পিটার হাস ঢাকায় বিএনপির ‘নিখোঁজ’ নেতা সায়েদুল ইসলাম সুমনের বাসায় গিয়ে সরকারপন্থি অন্য একটি সংগঠনের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। এরপর জাখারোভা ব্রিফিং করে বলেন, একজন মার্কিন কূটনীতিকের কার্যক্রমের প্রত্যাশিত ফলাফল এ ঘটনা। যিনি বাংলাদেশের জনগণের অধিকারের যত্ন নেওয়ার যুক্তি দেখিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরপর ঢাকায় রুশ দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিকে সব সময় মেনে চলায় রাশিয়া ‘দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, যারা বহিঃশক্তির নির্দেশনার পরিবর্তে জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নিজেদের পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণ করে থাকে, তারাও একই রকমের দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক মাসে ক্রমাগত বক্তব্য দিয়ে আসছে পিটার হাস।

তবে রাশিয়া বারবার বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচন কীভাবে হবে, এটি এই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। গত ৯ জুলাই চট্টগ্রামে এক আয়োজনে রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দর মতিঁতস্কি বলেন, বাংলাদেশই ঠিক করবে কোন প্রক্রিয়ায় এদেশে নির্বাচন হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে রাশিয়া, চীন ও ভারতের অবস্থান একই। তিনটি দেশই জানিয়েছে, বাংলাদেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, সেটি দেশের জনগণের বিষয়। বাইরের কোনো দেশের হস্তক্ষেপের বিরোধী তারা।

গতকাল শনিবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্যের বিষয়ে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো দলকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশের কোনো দলকে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রাধিকার দেয় না। বাংলাদেশের জনগণের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অভিন্ন লক্ষ্য পূরণে এবং বাংলাদেশিদের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মীরা সরকার, বিরোধীদল, নাগরিক সমাজ ও অন্য অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের এসব মন্তব্যে রাজনীতিক বিশ্লেষকদের মতে, কূটনীতিকরা সংবিধানের বাইরে গিয়ে আলোচনা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন না বলে মনে হচ্ছে। কারণ নির্বাচন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিদেশি দূতদের হস্তক্ষেপ মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ পুরোনো ঘটনা।

গত ৮ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য না করার জন্য বিদেশি কূটনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানান। একইসঙ্গে কূটনীতিকদের কর্মকাণ্ডে সীমা লঙ্ঘন যেন না হয়, সেজন্য ভিয়েনা কনভেনশনের কথাও মনে করিয়ে দেন।

শাহরিয়ার আলম বলেন, নির্বাচন নিয়ে দূতাবাস প্রধানদের দৌড়ঝাঁপ বাংলাদেশ ভালোভাবে নিচ্ছে না। তাদের (ঢাকার বিদেশি দূতাবাস) শুধু কালচারাল স্পেস দিয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের দেশের সিদ্ধান্ত আমরাই নেব।

আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে দেশের জনগণ কারো নাক গলানো পছন্দ করে না, করবেও না। বিএনপির জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা না থাকায় শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা নিজের দেশকে ছোট করছে। কোনো বিদেশি তাদের ক্ষমতায় বসাতে পারবে না। সেই ক্ষমতাও তারা রাখে না।

নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশিদের তৎপরতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ উজ জামান বলেন, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বিদেশিদের এ ধরনের তৎপরতা সমর্থনযোগ্য ও কাম্য নয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এটাকে আমি ওয়েলকাম করি না। আমাদের দেশের চেয়ে বিভিন্ন দেশে অনেক বড় বড় সমস্যা রয়েছে। আমাদের নির্বাচন তো আইন ও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই হয়। তারপরও কোনো সমস্যা থাকলে সেটা দেশের জনগণই তা মিট করবে। আমি মনে করি বিদেশিদের এ ধরনের হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে দেশের নাগরিক হিসেবে সবার সচেতন থাকা উচিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত