সার্ভার ডাউনের কবলে জন্মনিবন্ধন

আটকে যাচ্ছে স্কুলে ভর্তি উৎকণ্ঠায় অভিভাবক

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সার্ভার সমস্যায় জন্ম নিবন্ধন ও ইজিপি টেন্ডারে জটিলতা দেখা দিয়েছে। বছরে পর বছর সার্ভার ডাউনের ইস্যু আলোচনায় থাকলেও কোনো সুরাহ করেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। ফলে জন্ম নিবন্ধনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়েছেন লাখো মানুষ।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, গত বৃহস্পতিবার ইজিপি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সার্ভার সমস্যা থাকায় প্রায় ৪ ঘণ্টা অনলাইনে সকল কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কিন্তু এরপরও ইজিপিতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ভোগান্তি দূর হয়নি। এখন সার্ভার ডাউন থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটারের সামনেই বসে থাকতে হচ্ছে। এতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।

জানা গেছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ইজিপি টেন্ডার প্রক্রিয়ার সমস্যার মতোই অন্যান্য সংস্থাগুলো সমস্যার মুখে পড়ছে। একই অবস্থা জন্মণ্ডমৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও। সার্ভার নেই, বাবা-মায়ের নামের বানান ভুল, অনলাইন কপিতে সমস্যাসহ নানা জটিলতার অজুহাতে মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বহু আবেদন।

তবে যদিও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয় বলেছে, সার্ভার নিয়ে কোন জটিলতা নেই, বরং স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছা করে অথবা অদক্ষতার কারণে সেবা দিতে পারছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ভিসা আবেদনসহ ১৯টি নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

বিশেষ করে জুলাই মাসে লাখ লাখ মানুষের তথ্য ফাঁসের ঘটনার পর সার্ভার ডাউনের সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। সামনে শিশুদের স্কুলে ভর্তি এবং অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল স্কুল থেকে বোর্ডে পাঠানোর প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধনের নতুন আবেদন ও সংশোধনের ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আবেদন করতে পারছেন না অনেক অভিভাবক। এক অভিভাবক জানান, মেয়ের পাসপোর্টের প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধনের ভুল সংশোধনে তিনি বাসায় কম্পিউটারে আবেদন করতে ব্যর্থ হন। পরে দোকানে গিয়ে আবেদন করতে ব্যর্থ হন। কেন্দ্রীয়ভাবে সার্ভার ডাউনের সমস্যার কথা জানিয়ে দোকানের কর্মীরাও তাকে ফেরত পাঠান। এখন তিনি কোথায় যাবেন বুঝতে পারছেন না।

এদিকে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের যেসব শিক্ষার্থীর জন্মনিবন্ধন নেই, তাদের তালিকা করতে সারা দেশের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) চিঠি দিয়েছে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। এসব শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় আনতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে গত ২৫ অক্টোবর রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় ওই চিঠি দিয়েছে। সরকারের উপবৃত্তি পাওয়ার জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। তবে অনেক শিক্ষার্থীর তা নেই। ফলে তারা উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, সারা দেশে ৭ থেকে ৮ লাখ শিক্ষার্থী জন্মনিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছেন।

রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসানের স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়েছে, অনেক শিক্ষার্থীর জন্ম নিবন্ধন না থাকায় তারা সরকারের সামাজিক কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত সবচেয়ে বড় কর্মসূচি ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি’ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ খাতে বরাদ্দ করা টাকার বড় একটি অংশ অব্যয়িত থেকে যাচ্ছে। এর ফলে সরকারের সামাজিক সুরক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা তৈমুর আহমেদ। ছেলের জন্মসনদ করাতে প্রথমে যান স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে। সেখান থেকে বলা হয় সার্ভার সমস্যার কারণে আবেদন গ্রহণ করা যাচ্ছে না। পরে তিনি যোগাযোগ করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মূল কার্যালয়ে। সেখানেও একই জবাব দেওয়া হয়। পরে তিনি বাধ্য হয়ে জন্মনিবন্ধন অধিদপ্তর কার্যালয়ে যোগাযোগ করে আবেদন করেন এবং জন্মনিবন্ধন সনদ গ্রহণ করেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যাত্রাবাড়ী অঞ্চল-৫’এ জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করতে এসেছেন জান্নাতুল ফেরদাউস। তিনি বলেন, আসছে জানুয়ারি মাস, মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য জন্ম নিবন্ধনের দরকার। সেজন্য কয়েক দিন ধরে এখানে (যাত্রাবাড়ী) আসছি, কিন্তু সার্ভার সমস্যা থাকায় আবেদন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। জান্নাতুল ফেরদাউসের মতোই সার্ভার জটিলতায় আটকে গেছে ভর্তি সনদ প্রদান কার্যক্রম।

রাজধানী ঢাকায় জন্ম সনদ দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ দুই সিটি করপোরেশন, তবে সার্ভার ডাউনের কারণে জন্ম নিবন্ধন সনদ দিতে পারছে না। এ অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন শতাধিক শিশুর অভিভাবকরা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে সব অফিসের চিত্র একই।

ডিএনসিসি অঞ্চল-৫-এ কর্মরত কম্পিউটার অপারেটর বলেন, সার্ভার ডাউন থাকায় সেবাগৃহিতার পাশাপাশি আমরাও ভোগান্তিতে আছি। সারা রাত কম্পিউটার বন্ধ করি নাই। রাতে যেগুলা ইনপুট দিছি, এখনো বাইর হয় নাই। এত কষ্ট করে লাভ নেই।

সিরাজুল ইসলাম অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও সব শিক্ষাসনদে তার জন্ম ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি। তবে জন্মনিবন্ধন সনদে জন্ম তারিখ ভুল। সম্প্রতি বিদেশে শিক্ষার্থী ভিসার আবেদনের প্রয়োজনে জন্মনিবন্ধনে থাকা বয়স সংশোধনের প্রয়োজন হয় তার। কয়েক বছর ধরে নিজ এলাকা গাইবন্ধা ও ঢাকা ঘুরে এ সমস্যার কোনো সুরাহা করতে পারছেন না। এরই মধ্যে ১ অক্টোবর জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে তার জন্মসনদ সংশোধন করা যাবে না বলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে, যারা জন্মসনদে বয়স সংশোধনের জন্য ঘুরছেন। ‘সার্ভার ডাউন’ সমস্যায় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নতুন আবেদন ও সংশোধন নিয়ে এখন সমালোচনার মুখে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে মানুষ চরম ভোগান্তিতে রয়েছে। সার্ভার জটিলতায় জন্ম নিবন্ধন সনদ পেতে জামালপুরের ইসলামপুর পৌরবাসী ভোগান্তিতে পড়েছেন। ফলে স্কুল-কলেজে ভর্তি, পেনশন, পাসপোর্ট, জমি রেজিস্ট্রিসহ বিভিন্ন কাজে অনেকেই জটিলতা পোহাচ্ছেন। সার্ভার জটিলতায় অনেকে মাসের পর মাস ঘুরেও জন্ম সনদ নিতে পারছেন না। কম্পিউটার অপারেটররা জানান, সার্ভার নেই, সার্ভার এলে পাবেন। কবে আসবে সেই সার্ভার তা বলতে পারছেন না কেউ। ভুক্তভোগীরা জানান, কম্পিউটারের সামনে বসে নিজেরাও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সার্ভার ডাউন দেখায়। দীর্ঘদিনেও সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ তুলেছেন তারা। একই অবস্থা কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, জন্ম ও মৃত্যু সনদ সফটওয়ার লগইন করতে পারছেন না। অনেক সময় সাইটে প্রবেশ করতে পারলেও সময়মতো অ্যান্ট্রি হচ্ছে না। আবার অ্যান্ট্রি হলেও সনদ প্রিন্ট হয় না। এছাড়া সময়মতো পেমেন্ট কাটে না, কাটলেও শো করে না। এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এ কার্যক্রম। হোসেন্দী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সারোয়ার হাসান বলেন, গতকাল এক ব্যক্তি এসেছেন মৃত্যু সনদ নেয়ার জন্য। ওনার আত্মীয় নাকি বিদেশে মারা গেছেন। অতি জরুরি হওয়া সত্ত্বেও আমরা সনদটি দিতে পারিনি। হোসেন্দী ইউপি চেয়ারম্যান মো. হাদিউল ইসলাম বলেন, গত দুই মাস ধরে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। সময়মতো নাগরিকদের এসব সনদ দিতে না পারায় তারা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। বিষয়টি সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে বললেও অনেকে বুঝতে চান না। বিষয়টি সমাধানের জন্য ইউএনও মহোদয়ের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোজলিন শহীদ চৌধুরী বলেন, সার্ভার জটিলতার কারণে সারা দেশের মতো আমাদের এখানেও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।

জানা গেছে, নামের বানানসহ ছোটোখাটো সমস্যা ইউনিয়ন পরিষদ ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে সংশোধন করা যায়। জন্মের দিন ও মাসের ভুল সংশোধন করতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালকের (ডিডিএলজি) কাছে আবেদন করতে হয়। আর জন্মের বছর সংশোধনের ক্ষেত্রে ঢাকায় অবস্থিত রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সিদ্ধান্তই সব।

গত রোববার থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) মিলনায়তনে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনবিষয়ক আইন ও বিধির প্রয়োগের ওপর প্রশিক্ষণ কর্মশালায় রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বলেন, সঠিক জন্ম নিবন্ধন বাল্যবিয়ে ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার মৃত্যু নিবন্ধনের সঙ্গে সম্পত্তি বণ্টনের বিষয়টি জড়িত। এছাড়া জালিয়াতি করে অন্য কোনো দেশের নাগরিক যাতে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিবন্ধন করতে না পারে সে ব্যাপারেও এ নিবন্ধন জরুরি ভূমিকা রাখে। তাই এ নিবন্ধনে জড়িত কর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যাতে নিবন্ধন করতে গিয়ে ভোগান্তিতে না পড়ে সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।