ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৬ বছর পূর্তি

উন্নয়নের ছোঁয়ায় অর্থনৈতিক বিপ্লব

উন্নয়নের ছোঁয়ায় অর্থনৈতিক বিপ্লব

দেশের তিন পার্বত্য জেলায় সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন গড়ে ওঠেছে। সেই সঙ্গে চলছে উন্নয়নের জোয়ার। ২৬ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থা ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প-কারখানা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ অনেক খাতেই সরকার নানামুখী উন্নয়ন পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রসার ঘটেছে পর্যটন শিল্পেরও। একসময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে ছোট ছোট বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। এসব গোষ্ঠী নিজেদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে সহিংসতার পথে এগিয়ে যায়। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার ফলে পার্বত্য জেলাগুলোতে স্বস্তি ফিরেছে। গুরুত্বের বিচারে এই শান্তিচুক্তি দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক সাড়া ফেলে। আজ সেই শান্তিচুক্তির ২৬ বছর পূর্তি। এর মধ্য দিয়ে পার্বত্য জেলায় ব্যাপক পরিসরে অবকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির কারণে পাহাড়ে স্বস্তি ফেরেছে। বন্ধ হয়েছে রক্তপাত-হানাহানি। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে রক্ষক্ষয়ী সংঘাতের ঘটনা নেই বললেই চলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য দূর হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে এখন শান্তির সুবাতাস বইছে। স্থিতিশীল পরিস্থিতির পেছনে কাজ করছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পৌঁছে যাচ্ছে খাদ্য ও ত্রাণ সহযোগিতা। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দিতে ভূমিহীন বাছাই করতে দুর্গম পাহাড়ে ছুটে চলছেন মাটিরাঙা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পাহাড়ে পাহাড়ে ছুটে খুঁজে বের করা হয় অসহায়, হতদরিদ্র, গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার। তাদের নিয়মিত সহযোগিতা করছে স্থানীয় প্রশাসন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি দুর্গম পাহাড়ের বাসিন্দাদের কেউ অসুস্থ হলে আগের মতো মাইলের পর মাইল হেঁটে অথবা রোগীকে কাঁধে তুলে নিয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হয় না। বর্তমানে হাসপাতাল নাগালের মধ্যে। মাইলের পর মাইল পাহাড়ে পায়ে হেঁটে চলাচলের চিত্র বদলে গেছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটনায় মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, চান্দের গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে খুব সহজেই মানুষ গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারছেন।

রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার উদয়পুর গ্রামের তনয় চাকমা বলেন, কয়েক বছর আগে তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা ওঠে। সে সময় দুই দিকে বাঁশের সঙ্গে কাপড় বেঁধে তার ভেতরে শুইয়ে প্রায় ২০ মাইল হেঁটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডাক্তারের কাছে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগেই মারা যায় তার স্ত্রী। তবে এখন আর কাউকে পায়ে হেঁটে ডাক্তার কিংবা হাসপাতালে যেতে হয় না। এখন দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়েছে, খুব সহজেই চান্দের গাড়িতে করে রোগীকে নিয়ে যাওয়া যায়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে সরীসৃপের মতো নির্মিত শত শত কিলোমিটারের আঁকা-বাঁকা পিচঢালা মসৃণ পাহাড়ি সড়কগুলো অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। সড়কের পাশাপাশি বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট এক পাহাড়কে আরেক পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দুই-তিন দিনের গন্তব্যে এখন কয়েক ঘণ্টাতেই যাওয়া-আসা করা যায়। পাহাড়ি জনপদের মানুষের কাছে এটি স্বপ্নের মতো। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, দেখতে পিকআপের মতো যাত্রীবাহী চান্দের গাড়ি, বাস, মাইক্রোবাস ও জিপ নিয়মিত চলাচল করছে সড়কগুলোতে। পাশাপাশি নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যাও। এরই মধ্যে খাগড়াছড়ির বেতলিং, রাঙামাটির মাঝিরপাড়া ও সাইচলে পাহাড়ের কোলঘেঁষে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে। এটিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উঁচু সড়ক নির্মাণের কীর্তি। এ সড়কের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির পর তিন পার্বত্য জেলায় অবকাঠামো খাতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। শান্তি চুক্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলে পাকা রাস্তা নির্মাণ হয়েছে ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার। কাঁচা সড়ক ৭০০ কিলোমিটার, সড়ক সংস্কার ৬১৪ কিলোমিটার ও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৮৩৯ মিটার, কালভার্ট হয়েছে ১৪১টি। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিশুপার্ক, বাস টার্মিনাল, ঈদগাহ, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, ক্যান্টনমেন্ট, বাঁধ, স্টেডিয়াম নির্মাণ, ফুড বেকারি, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটন কেন্দ্র, সোলার প্যানেল বিতরণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এভাবে পাড়ায় পাড়ায় পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, বিগত ২৬ বছরে সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। তাদের চোখ এখন উন্নয়নের দিকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার যত উন্নতি হবে, তত জীবনমান উন্নত হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয় বাসিন্দা থিয়াং ত্রিপুরা বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এ এলাকার মানুষ পাহাড়ের ফলমূল, শাকসবজি শহরে পাঠাতে পারে সহজে। আগে কেউ অসুস্থ হলে রাস্তার কারণে কোথাও নেওয়া যেত না। দুর্গম এলাকার মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। কিন্তু রাস্তা করে দেওয়ায় তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। বেশ কয়েকটি দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পার্বত্য জেলা সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। এছাড়া বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, সীমান্ত এলাকার কৃষিপণ্য দেশের মূল ভূখণ্ডে পরিবহনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। বিশেষ করে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের মিজোরামণ্ডত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে এটি।

গবেষণার কাজে পার্বত্য অঞ্চল পরিদর্শন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমডি আব্দুর রহিম বলেন, কয়েক বছর আগেও পার্বত্য জেলায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌপথ। বিভিন্ন এলাকায় নৌপথে যেতে দিন ফুরিয়ে যেত, সেখানে এখন সড়ক পথে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যাওয়া-আসা করা যাচ্ছে। এমন উন্নত সড়ক ব্যবস্থা হবে তারা স্বপ্নেও ভাবেননি। এছাড়াও পাহাড়ে কৃষি সম্ভাবনার কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। যার ফলে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালিদের কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমন স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক পরিবর্তনও ঘটবে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্যাঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক উন্নত সাধিত হয়। সেই সঙ্গে পর্যটন শিল্প ও স্থানীয় মানুষের জনজীবনে গতিসঞ্চার হয়। পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বিরাজ করছে। যার ফলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। এছাড়া সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। তারা এখন নির্দ্বিধায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন। অন্যদিকে পার্বত্যাঞ্চলে বেড়েছে পর্যটকের সংখ্যাও।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বিদেশি কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং জনসংহতি সমিতির পক্ষে জেএসএসের সভাপতি ও শান্তিবাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যেটাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বলা হয়ে থাকে। তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই দীর্ঘদিনের সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান এবং এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত