বাড়ছে ভূমিকম্পের মাত্রা ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ক্রমশই ভূমিকম্পের মাত্রা বাড়ছে বাংলাদেশে। এতদিন ভূমিকম্পের মাত্রা ৪ থেকে ৫ মাত্রার কাছাকাছি থাকলেও এবারই গতকাল ৫ দশমিক ৬ মাত্রায় ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটল, যা মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এছাড়া চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ছোট ও মাঝারি ধরনের ১১ বার ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠেছে দেশ। তবে এসব ভূমিকম্পে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে দেশে মৃদু এবং মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানছে। এসবের উৎপত্তিস্থলও খুব দূরে নয়, দেশের অভ্যন্তরে অথবা খুব কাছাকাছি কোথাও। গত সেপ্টেম্বরেই তিনবার ভূমিকম্প হয়েছে। দুটি হয়েছে আগস্ট মাসে। তবে ছয়টি ভূমিকম্পের মধ্যে দুটিরই উৎসস্থল ছিল ডাউকি চ্যুতিতে। বাংলাদেশের মাটির নিচে ভূমিকম্পের দুটি বড় উৎস আছে। তার মধ্যে ডাউকি চ্যুতি একটি। আর এখানে একের পর এক ভূমিকম্প হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা নেই।

রাজধানীসহ সারাদেশে মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে গতকালের ৫ দশমিক ৬ মাত্রায় ভূমিকম্প। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের বিভিন্ন স্থানে খসে পড়েছে পলেস্তারা। ভেঙে পড়েছে পাঠকক্ষের দরজার গ্লাস। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়; ভূকম্পন অনুভব করেছেন চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দারাও। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হয়ে ভবন থেকে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে কুমিল্লার একটি পোশাক কারখানার দুই শতাধিক পোশাকশ্রমিক আহত হয়েছেন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, ভূকম্পনটির উৎপত্তিস্থল ছিল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-উত্তর দক্ষিণে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বলেছে, ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬ ছিল। উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা ৮৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রামগঞ্জে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫ কিলোমিটার গভীরে এর কেন্দ্র ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬ মাত্রা ভূমিকম্প হয়েছে।

চলতি বছরে অন্তত ১১ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। প্রথম ভূকম্পন অনুভূত হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। এই ভূকম্পনের মাত্রা ৩ দশমিক ৯ ছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের পাশাপাশি কক্সবাজারেও ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। ওই দিন রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। আবার ৩০ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে চট্টগ্রাম। ৫ মে আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। ১৬ জুন রাজধানীসহ সারা দেশে ৪ দশমিক ৫ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প হয়। ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিটের দিকে একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। মাত্রা রিখটার স্কেলে ছিল ৫ দশমিক ৫, যা মাঝারি মাত্রার একটি ভূমিকম্প। এর উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। ২৯ আগস্ট আরেক দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও এর উত্তরের কয়েকটি জেলায় হালকা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ২, যা মাত্রা অনুযায়ী হালকা ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়। গত অক্টোবরে মেঘালয়ের ৫ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপে বাংলাদেশ। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে। অন্যদিকে গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫ দশমিক ৬ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।

চলতি বছরের মার্চে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে যে চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবেন ২ লাখ ২৯ হাজার।

বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেটের ফল্ট লাইনে দিনের বেলা ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫ ভবন ধসে পড়তে পারে। ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা সমমূল্যের।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়, যার প্রকৃত উদাহরণ হিসেবে গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ১১ মিনিটে মরক্কোয় ঘটে যাওয়া রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার মাত্রার ভূমিকম্পে ৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। মরক্কোর ভূমিকম্পের পরের দিন বাংলাদেশেও মৃদু ভূমিকম্প দেখা দেয়। ওই দিন সিলেটে অনুভূত ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম। ২০০৩ সাল থেকে ভূমিকম্প নিয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের মতে, ভূ-তাত্ত্বিক ও টেকনোটিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। একটা ইন্ডিয়া প্লেট এবং এর পূর্বে বার্মা প্লেট এবং উত্তরে এশিয়া প্লেট। ইন্ডিয়া এবং বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে। বলা হয়, প্লেটের সংযোগস্থলে ৮০০ থেকে ১০০০ বছর আগে ভূমিকম্প হওয়ার ফলে এই অংশে যে শক্তি জমা রয়েছে, সেটা একসঙ্গে বের হলে ৮ দশমিক ২ স্কেলের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শক্তি একবারে বের না হয়ে আংশিক বের হলে ভূমিকম্পের মাত্রা কম হবে। আর এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকার কাছে হওয়ায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা রাজধানীর ভবনগুলো ভেঙে পড়বে এবং বহু মানুষ নিহত হবে।

২০২১-২৫ সালের বাংলাদেশ জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় বলা হয়- বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সারা দেশে ৬ কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে ১১ রাখ ৯ হাজার পাকা ভবন, ২১ লাখ ১৪ হাজার সেমিপাকা ভবন ৪০২টি খাদ্য গুদাম, ১৪টি গ্যাসফিল্ড, ১৯৫টি হাসপাতাল, ১ হাজার ৮টি কল্যাণ কেন্দ্র, ২ হাজার ৮০০ উচ্চবিদ্যালয়, ১ হাজার ৯০০ মাদ্রাসা, ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬ হাজার ৮০০ পুলিশ স্টেশন, ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৭ হাজার ৪০০ কিলোমিচার স্থানীয় সড়ক, ২০ হাজার সেতু এবং ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী মনে করেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা গেছে। তার মানে, যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, ভূমিকম্পে ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও দিনাজপুর অঞ্চলই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের মেঘালয়, আসাম, মনিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমার সীমান্তের কাছে রিখটার স্কেলে ৭ এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে ভয়াবহ।

গত ২০০ বছরে বাংলাদেশে আটটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১, যা সর্বোচ্চ ১০ মাত্রায় পৌঁছে। এ ভূমিকম্পে ব্যাপক সম্পদহানি ছাড়াও মৃত্যুবরণ করে ১ হাজার ৫৪২ জন মানুষ। ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪ মাত্রার ১১৫টি এবং ৫ মাত্রার ১০টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ২০১৬ সালের ২৪ আগস্টে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার আগারগাঁও আবহাওয়া অফিস থেকে মাত্র ৫২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের চাউক অঞ্চলে।