ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিএনপির অফিসে রহস্যময় তালা!

হতে পারে নতুন কৌশল
বিএনপির অফিসে রহস্যময় তালা!

বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল ফটকে গত ২৮ অক্টোবর থেকে তালা ঝুলছে। কার্যালয়ের আশপাশে রয়েছে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য। দেখা নেই দলটির কোনো নেতাকর্মীর। ভেতরে ভুতুড়ে পরিবেশ। সুনশান নীরবতা। কার্যালয়ের সামনে সাধারণ মানুষের চলাচল কম। কেউ কাছে গিয়ে দেখছেন ভেতরের কী অবস্থা, কেউ কেউ বা ছবিও তুলছেন। আবার কেউ ভয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছেন। গতকাল শনিবার বিকাল ৩টার দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করে এরপর এমন চিত্র দেখা যায়। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে হামলার ১ মাস ৪ দিন পরও খোলা হয়নি নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তালা। এই তালাটিকে এখন অনেকে রহস্যময় তালা হিসেবেও আখ্যায়িত করছে। এই তালার চাবি কার কাছে? কে তালা লাগিয়েছে? কবে খোলা হবে এই তালা- এমন নানা প্রশ্ন এখন সর্বমহলে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২৮ অক্টোবর রাতে বিএনপির সংবাদ সম্মেলনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এরপর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে যেতে পারছেন না। অন্যদিকে, পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি কার্যালয়ে দলটির শীর্ষ নেতারাই তালা ঝুলিয়ে রাখছেন। পুলিশ শুধু নিরাপত্তার স্বার্থে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ও পাশের গলিতে অবস্থান করছে।

সরেজমিন দেখা যায়, বিএনপির কার্যালয়ের কলাপসিবল গেইটে ঝুলছে তালা। ভেতরে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার একটির ওপরে আরেকটি রাখা। চেয়ারগুলোর ওপর কয়েকটি পত্রিকা ও চিঠি রেখে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও জমেছে ধুলার আস্তর। রিসিপশন টেবিলে ধুলো আর ময়লা। আশপাশে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। একই চিত্র দেখা যায় পাশের সেমিনার হলেও। আশপাশে বেশ কিছু পুলিশ সদস্য অবস্থান করছেন। পাশের ফুটপাত ও সামনের রাস্তা অনেকটায় ফাঁকা। কার্যালয়ের সামনের অংশটুকুতে পথচারীদের রাস্তায় নেমে হাঁটতে হচ্ছে।

বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে দায়িত্বরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলার অবনতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। সকাল থেকে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে কার্যালয়ে আসতে দেখি নাই।

সূত্র মতে, এক-এগারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দীর্ঘদিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ ছিল। পরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করে অফিসে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের পর কয়েকবার বিএনপির অফিসে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এসব তল্লাশির পর ১ থেকে ২ দিন করে কখনো কখনো বিএনপির কার্যালয় বন্ধ ছিল। সবশেষ ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর পুলিশ বিএনপির কার্যালয়ে তল্লাশি চালায় এবং দলের প্রায় ৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় ৪ দিন কার্যালয়টি বন্ধ করে রেখেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জানা যায়, গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে কাকরাইল মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপি। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যায়। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ। সেদিন হরতাল ঘোষণা দিয়ে দ্রুত মঞ্চ ত্যাগ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর থেকেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক নিয়ন্ত্রণে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কার্যালয়ের সামনের অংশে ‘ক্রাইম সিন’ লেখা হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুই দিন ধরে আলামত সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুই দিন পর দেয়া হয় কাটাতারের বেড়া।

তপশিল ঘোষণার পরদিন তাও সরিয়ে নেয়া হয়। অবরোধ সমর্থনে গত ১৫ নভেম্বর কার্যালয়ে সামনে অবস্থান নিলে জাতীয়বাদী জনতা দলের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়া দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে অবস্থান করছে পুলিশ ও সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন) বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছেন, ‘বিএনপির নেতারা যদি তাদের অফিসে না যায়, এতে আমাদের কী করার আছে। এছাড়া পুলিশ তাদের অফিসে তালা দিয়ে রেখেছে এটি অপ্রচার। বিএনপি নেতারা ভয়ে হয়তো অফিসে যায় না। তারা তাদের অফিসে যাবে এতে আমাদের তেমন কোনো বিষয় না।

জানতে চাইলে ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান জানান, নয়াপল্টনে ২৮ অক্টোবরের সংঘাতের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপি অফিসের সামনে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পুলিশ তাদের অফিসে তালা দেয়নি। তারা তাদের অফিসে গেলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ কাজ করছে।

বিএনপির নেতারা বলেছেন, ২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষের পর সেদিন রাত ৮টা থেকে গত একমাস কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। কারণ, এবারের পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। প্রতিদিন নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নেতাদের না পেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে নেতারা আত্মগোপনে আছেন। কার্যালয়ের তালা খোলার প্রসঙ্গে তারা বলেন, দেশের বিদ্যমান যে পরিস্থিতি তাতে কবে কার্যালয় খোলা হবে, বলা সম্ভব নয়। তবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে কীভাবে স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফেরা যায়, তা নিয়ে দলের শীর্ষ মহলে চলছে আলাপ-আলোচনা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির শিশুবিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী বলেন, সারাদেশ বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে অধিকাংশই ঘরবাড়ি ছাড়া। বাসায় নেতাকর্মীদের না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নয়াপল্টনে ২৪ ঘণ্টাই পুলিশ অবস্থান করছে। নেতাকর্মীরা গেলেই তাদের গ্রেপ্তার করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ অবস্থায় কীভাবে নেতাকর্মীরা কার্যালয়ে যাবে?

কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতা শরীফুল ইসলাম শাওন জানান, বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মী আত্মগোপনে আছে। আমরা কার্যালয়ের ধারে কাছেও যেতে পারি না। পুলিশ সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় কার্যালয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তবে অনেকে বলেছেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি অফিসে তালা দলটির একটা কৌশলও হতে পারে।

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের ভেতর থেকে তালা লাগানো। পুলিশ না থাকলেও ওই অফিসে কোনো নেতাকর্মীর চলাচল নেই। গুলশানে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ভোট বর্জন করে বিএনপি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলে দলটি। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। ২০১৪ সালের মতো ২০২৪ সালের ভোটও বর্জন করল বিএনপি। দলটি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল প্রত্যাখ্যান করে সরকার পতনের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত