ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হরতাল-অবরোধে স্বস্তির বাহন মেট্রোরেল

* বাসে আগুন, মেট্রোতে নিরাপদ * যাত্রীদের চাপ বাড়ছে মেট্রোতে
হরতাল-অবরোধে স্বস্তির বাহন মেট্রোরেল

রাজধানীবাসীর কাছে চলাচলের স্বস্তি ও নিরাপদ বাহন হচ্ছে মেট্রোরেল। মাঠের রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর হরতাল-অবরোধে বাসে আগুন দেওয়ায় মেট্রোরেলে যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি অসিফগামী মানুষ অল্প সময়ে খুব সহজেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারছেন। এতে গত রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অফিস সময়ে মেট্রোতে যাত্রীচাপ বেশি হচ্ছে। চাপ সামলাতে ট্রেনের বগি বাড়ানো বা ট্রেন বাড়ানোসহ রাতেও মেট্রোরেল চালুর দাবি জানিয়েছেন যাত্রীরা। সরেজিমন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনে টিকিট কাউন্টারে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। সড়ক পথে যানজট ভোগান্তি ও অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্ক থেকে বাঁচতে স্বস্তিতে মেট্রোরেলের যাত্রা করছেন মানুষ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মেট্রোরেল অফিসে যাওয়া-আসা করছেন। ১০ মিনিট পরপর উত্তরার তিনটি স্টেশন থেকে মেট্রোরেল ছাড়লেও প্রতিটিতে যাত্রীবোঝাই। এসব স্টেশন থেকে যাত্রীবোঝাই করেই পল্লবী স্টেশনে আসছে। পল্লবীতে অল্পকিছু যাত্রী নামলেও উঠছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বেশিরভাগ যাত্রীর গন্তব্য মতিঝিল, সচিবালয়, ফার্মগেট ও আগারগাঁও। তবে যেসব যাত্রীর মেট্রোপাস নেই তাদের কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। টিকিট নেওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকেই গণপরিবহনে তুলনামূলক যাত্রী কমছে।

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপণা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আবু সাইদ মো. কামাল মিরপুর থেকে নিয়মিত মেট্রোরেলে চড়ে সচিবালয়ে অফিস করছেন। তিনি বলেন, মেট্রো সবচেয়ে আধুনিক আর দ্রুতগতির গণপরিবহন ব্যবস্থা। শুধু গতিই নয়, মেট্রোরেল একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যাত্রী নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। এজন্য উন্নত বিশ্বে যাত্রী পরিবহনে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে মেট্রোরেল। এই আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে বাংলাদেশও। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় যাতায়াত সহজ হয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে মিরপুর থেকে সচিবালয়ে আসছি। আগে যেখানে গাড়িতে চড়ে যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হতো, এখন আর সেটি নেই। মেট্রোরেল চালু থাকায় সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছা যায়।

মেট্রোরেলের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, রাত ৮টা ১৫ মিনিট এবং রাত সাড়ে ৮টায় দুটি মেট্রোরেল আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে প্রতিটি মেট্রোরেল স্টেশনে থেমে উত্তরা উত্তর মেট্রোরেল স্টেশন পর্যন্ত চলছে। এই মেট্রোরেল দুইটিতে শুধুমাত্র এমআরটি পাস এবং ভ্রমণের দিন রাত ৭টা ৪৫ মিনিটের পূর্বে ক্রয়কৃত একক যাত্রীর টিকিটে ভ্রমণ করতে পারবেন। রাত ৭টা ৪৫ মিনিটের পর সব টিকিট বিক্রয় অফিস এবং টিকিট বিক্রয় মেশিন বন্ধ হয়ে যায়। উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সব মেট্রোরেল স্টেশন হতে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত; এবং মতিঝিল, বাংলাদেশ সচিবালয় ও ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশন হতে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এমআরটি পাস ক্রয় করা যাবে।

জানা গেছে, গত ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করে রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা। প্রথমে চালু হয়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচল। এরপর মেট্রোরেলে আগারগাঁও পেরিয়ে বিস্তৃত হয়েছে বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ব্যস্ততম মতিঝিল এলাকা পর্যন্ত। এতে এই পরিবহনে যাত্রী চলাচল বেড়েছে। মেট্রোরেলে চলাচলের পুরো প্রক্রিয়া মানুষের আগ্রহী করে তুলেছে। একজন যাত্রী একবারের যাত্রায় পাঁচটির বেশি টিকিট কাটতে পারবেন না। টিকিটের জন্য মেট্রোরেলের টিকিট কাউন্টারে বাটনে চাপ দিলেই মেশিন টাকা চাইবে। টাকা দিলেই টিকিট বেরিয়ে আসে। মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটার যেতে যাত্রীর গুণতে হবে ৫ টাকা ভাড়া। তবে যাত্রীপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। আপাতত কেবল উত্তরা থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত যাওয়া-আসা করা যাবে, আর এজন্য ভাড়া গুণতে হবে ৬০ টাকা। মেশিনে সর্বনিম্ন ২০ টাকা আর সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা প্রবেশ করানো যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিএনপির হরতাল-অবরোধে চলন্ত গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। সেই কারণে মেট্রোরেলে ভিড় থাকলেও যাত্রী খরা দেখা গেছে উত্তরা ও পল্লবী রুটে চলাচলকারী বাসগুলোতে। উপরে মেট্রোরেলের বগিগুলো যখন যাত্রীতে পূর্ণ, তখন নিচে সড়কে বাসগুলোকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের।

শিকড় পরিবহনের চালকের সহকারী সোহান বলেন, একদিকে বিএনপির হরতাল-অবরোধ অন্যদিকে মেট্রোরেল চলছে, সেজন্য বাসে যাত্রী কম উঠছে। স্বল্প দূরত্বের লোকাল যাত্রী বাসে উঠছে বেশি। যাত্রীর জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অথচ মেট্রোরেল চালুর আগে যাত্রীদের চাপে বাসের গেট লাগাতে হয়েছে।

পুরানা পল্টন সজল লিমিটেডে চাকরি করেন কাজল মিয়া। নিয়মিত বাসে চলাচল করতেন, তবে মেট্রোরেল চালু হওয়ার শুরুর দিন থেকেই বাস রুট পরিবর্তন করে তিনি এখন মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী হয়েছেন। কাজল মিয়া বলেন, মেট্রোরেলে চলাচল করলে রাজনৈতিক সহিংসতা কিংবা যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। ঢাকার মতো একটি ব্যস্ত শহরে মেট্রোলে হওয়ায় লাখো মানুষের উপকার হয়েছে। কারণ, এই শহরে যে পরিমাণ যানজটে সময় ব্যয় হয়, তার চেয়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোরেলে দাঁড়িয়ে অফিসে যাতায়াতেও অনেক শান্তি আছে। সময় তো বাঁচবেই, সঙ্গে ভোগান্তি কমে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরের ৪ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন ৫ নভেম্বর থেকে শুরু হয় যাত্রীসেবা। এখন উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলছে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলাচল করছে। মতিঝিল মেট্রো স্টেশনের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশনগুলোর কিছু কাজ বাকি আছে। বলতে গেলে প্রায় ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ১০ ভাগ কাজ শেষ হলে পুরোপুরি মেট্রোরেল উত্তরা থেকে মতিঝিল ছুটবে।

মিরপুর থেকে সচিবালয় স্টেশনে নামবেন জাহিদ সরকার। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বাহন মেট্রোরেল। এখানে ভিড় কিংবা দাঁড়িয়ে এলেও স্বস্তির মধ্যে আছি। ট্রেনের ভেতর এসি থাকায় এবং যাওয়ার পথে জ্যাম না পড়ায় কষ্ট লাগছে না। বিশেষ করে অবরোধের মধ্যে রাস্তাঘাট নিরাপদ না। আর মেট্রোতে মাত্র ৩০ মিনিটে সচিবালয়ে আসা যায়।

বিএনপি-জামায়াত কয়েক দফার হরতাল ও অবরোধ ডাকছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস ও প্রাইভেট কারে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অবরোধ চলাকালেও রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। এমন সময়ে কর্মস্থলে যেতে ‘নিরাপদ বাহন’ হিসেবে মেট্রোরেলকে বেছে নিয়েছে মানুষ। হরতাল-অবরোধের মধ্যেও মেট্রোরেল ঘুরতে বের হন কাজী জাফর উল্লাহ। তিনি বলেন, ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। তখন মনে হলো, একটু মেট্রোরেলে চড়ি। তারপর ১০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে উত্তরা থেকে মতিঝিল আসলাম ৩০ মিনিটে। এখন আবার আমি ১০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে উত্তরা যাচ্ছি। মেট্রো ট্রেনের পরিবেশ খুব ভালো। বাসে উঠলে ধাক্কাধাক্কি হয়, কাপড়চোপড় নষ্ট হয়, মোবাইল ফোন সেট চুরি হয়। ঢাকায় অসহনীয় হয়ে ওঠা যানজট নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার। ২০ বছর মেয়াদি (২০০৪-২০২৪) ওই পরিকল্পনায় মেট্রোরেল, বাসভিত্তিক উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা বিআরটিসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ আসে। এর মধ্যে একটি লাইনের সুবিধা নিতে পারছেন নগরবাসী। এরই মধ্যে এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর রুট) ও এমআরটি লাইন-১ নামে আরো দুইটি লাইনের কাজ শুরু হয়েছে। সরকার বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তারা সবমিলিয়ে ছয়টি লাইন চালু করতে চায়। সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা জেরিন আফরিন বললেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল মাত্র ৩০ মিনিটে পৌঁছা যায়। আগে আমি ৭টার সময় রওনা দিলেও সময় মতো অফিসে ঢুকতে পারতাম না। আর এতদিন আমি সিএনজিতে যেতাম, যেটা আমার জন্য খুব এক্সপেন্সিভ ছিল। এবার থেকে শান্তি। তাছাড়া সবমিলিয়ে দেশের যা অবস্থা এখন, তাতে মেট্রোরেলে যাতায়াত করাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হচ্ছে। খুব বেশি খুশি হতাম, যদি রাত পর্যন্ত মেট্রোরেল চলত। কারণ, আমাদের ব্যাংকের ক্লোজিং হতে হতে তো সন্ধ্যা ৬-৭টা বেজে যায়। বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হয়ে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলছে মেট্রোরেল। আর উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে চলাচল করা যাচ্ছে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।

মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনাকারী কোম্পানি ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক জানিয়েছেন, উত্তরা অংশের মতো মতিঝিল অংশেও ট্রেন চলাচলের সময় ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে। তিন মাসের মধ্যে মাঝের সব স্টেশনও চালু হবে। তখন রাজধানীর বাসিন্দারা আরো বেশি মেট্রোরেলে সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত