ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পিসিটিতে বছরে হ্যান্ডেল পাঁচ লাখ কনটেইনার

পরিচালনায় সৌদি অপারেটর প্রতিষ্ঠান
পিসিটিতে বছরে হ্যান্ডেল পাঁচ লাখ কনটেইনার

চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেল সক্ষমতা বেড়েই চলেছে। একের পর এক অপারেশনাল কাজে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন টার্মিনাল। এখন টার্মিনাল পরিচালনায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানও যুক্ত হচ্ছে। গত বুধবার চট্টগ্রাম বন্দরে নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা নিয়ে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সৌদি আরবের আংশিক রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিওআই) কনসেশন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই টার্মিনালে প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডেল সক্ষমতা রয়েছে। এখনো টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডেল শুরু হয়নি। আগামী আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ নাগাদ চালু হতে পারে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বন্দর কর্মকর্তারা জানান, সারা বিশ্বের মতো দেশের বন্দরগুলোতে জাহাজ আসা যাওয়া বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরেও বাড়ছে জাহাজ আসা যাওয়া। সেই সঙ্গে নানা ধরনের পণ্য আমদানিও বেড়ে চলেছে। আমদানি রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেল সক্ষমতা জড়িত। অর্থাৎ, হ্যান্ডেল সক্ষমতা না বাড়লে আমদানি রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়। বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে গেল দেড় দশক ধরে কনটেইনার হ্যান্ডেলে বিশেষায়িত টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এর আগে চালু করা হয় বিশেষায়িত চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)। এরপর চালু করা হয় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। এবার পুরোপুরি তৈরি করা হয় পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বা পিসিটি। এই টার্মিনাল প্রথমবারের মতো সৌদি আরবের একটি প্রতিষ্ঠান হ্যান্ডেলে দায়িত্ব পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বন্দরের কোনো টার্মিনাল পরিচালনায় প্রথমবারের মতো কোনো অপারেটর প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলো।

গত বুধবার ওই সৌদি অপারেটর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয় কনটেইনার হ্যান্ডেলে। চুক্তি অনুযায়ী, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের নতুন এ টার্মিনাল আগামী ২২ বছর সৌদি কোম্পানিটি পরিচালনা করবে। এদিকে চুক্তি সইয়ের পর বুধবার দুপুরে সৌদি আরবের বিনিয়োগ বিষয়কমন্ত্রী খালিদ আল ফালিহের নেতৃত্বে একটি টিম চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিদর্শন করেন। এ সময় সৌদি মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলসহ কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, গত বুধবার সকালে নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা নিয়ে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এখন থেকে আগামী ২২ বছর এ কনটেইনার টার্মিনালটি পরিচালনা করবে বিদেশি এ প্রতিষ্ঠানটি। আগামী ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে তারা কাজ শুরু করবে। এই টার্মিনালে কনটেইনার শুরু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আরো বাড়বে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পিসিটি নির্মাণ করে। নতুন নির্মিত এই টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারবে। পতেঙ্গা এলাকায় নির্মিত এই টার্মিনালের মাধ্যমে বছরে ৪ লাখ ৪৫ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে।

জানা গেছে, টার্মিনালটি বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের বাকি টার্মিনাল থেকে এখানে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে। যেখানে বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ৯ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারে, সেখানে পিসিটিতে অপারেশনে গেলে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ১০ দশমিক ৫ মিটার এরপর ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ২০২২ সালের জুন মাসে এ টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়। বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি এই টার্মিনালের অবস্থান। চট্টগ্রাম বন্দরে বাকি টার্মিনাল থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার আগে। যে কারণে আসা-যাওয়া মিলে ১৪ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। এতে সাশ্রয় হবে জ্বালানি ও সময়। সেই সঙ্গে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ ভেড়ানো যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বাকি সব টার্মিনালে এ পরিমাণ ড্রাফটের জাহাজ বর্তমানে ভেড়ানো যাচ্ছে না। এতে বেশি কনটেইনার নিয়ে বড় জাহাজ ভেড়ার সুযোগ থাকায় খরচ কমবে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে।

২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও প্রকল্প এলাকায় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা স্থানান্তরসহ নানা জটিলতার কারণে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। বন্দরের ড্রাইডক থেকে বোট ক্লাব পর্যন্ত ২৬ একর জমিতে ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।

নতুন নির্মিত এই টার্মিনালে ৫৮৪ মিটার লম্বা জেটিতে একসঙ্গে তিনটি কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো যাবে। এখানে আছে, ২২০ মিটার দীর্ঘ ডলফিন (তেল খালাসের) জেটি, ৮৯ হাজার বর্গমিটার আরসিসি ইয়ার্ড, ২ হাজার ১২৮ বর্গমিটার কনটেইনার শুল্ক স্টেশন, ২ হাজার ১৫০ মিটার লম্বা ৬ মিটার উচ্চ কাস্টম বন্ডেড হাউস, ২ হাজার ৫০০ মিটার রেলওয়ে ট্রাক, ৪২০ মিটার ফ্লাইওভার, ১ হাজার ২০০ বর্গমিটার মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ এবং ৫ হাজার ৫৮০ বর্গকিলোমিটার অফিস ভবন।

চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বশেষ টার্মিনাল নির্মাণ করা হয় ২০০৭ সালে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল। দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় পর পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বাস্তবায়ন করা হয়। এটির ব্যবহার শুরু হলে বন্দরের টার্মিনালের সংখ্যা বেড়ে হবে চারটি। অন্যদিকে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বন্দরের মূল জেটির সংখ্যা হবে ২১টি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, সৌদি আরব, দুবাই, ভারত ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পিসিটি পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করে পস্তাবব দেয়। এর মধ্যে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে, দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, ভারতের আমদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড ও সিঙ্গাপুরের পিএস সিঙ্গাপুর পস্তাবব জমা দেয়। এসব প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জানা গেছে, রেড সি গেটওয়ে সৌদি আরবের জেদ্দা ইসলামিক পোর্টের বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর। প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনাল পরিচালনার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্দর সম্প্রসারণ ও নির্মাণ করে থাকে। জেদ্দা পোর্ট বিশ্বের শীর্ষ ১০০ বন্দরের তালিকায় ৪১তম। চট্টগ্রাম বন্দর ৬৭তম। রেড সি গেটওয়ে প্রস্তাবে বলেছে, পিসিটি পরিচালনায় নিজেদের অর্থে যন্ত্রপাতি কিনে ২২ বছরের জন্য এই টার্মিনাল পরিচালনার চুক্তি করবে প্রতিষ্ঠানটি। আর চুক্তির দিন থেকে গণনা শুরু হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত