ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিএনপির হরতাল-অবরোধে ২৭৯ গাড়িতে আগুন

২৪ দিনে পরিবহণ খাতে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি

বাড়ছে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
২৪ দিনে পরিবহণ খাতে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি

দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে এলেই অহিংস রাজনীতি সহিংতায় রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি শুরু হয়েছে। এতে দেশের মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন যাচ্ছে।

জানা গেছে, গত নভেম্বরে আট দফায় ১৭ দিন এবং ডিসেম্বরে নবম ও দশম দফায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এর বাইরে তিন দফায় তিন দিন হরতাল কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। সব মিলে মোট ২৪ দিন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। হরতাল-অবরোধের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া শাখার তথ্য মতে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ২৭৯টি অগ্নিসংযোগ এবং স্থাপনায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) শাহজাহান শিকদার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ২৮ অক্টোবর থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনায় ২৭৯ পরিবহণ ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরমধ্যে ২৬৪টি যানবাহন ও ১৫টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত এবং একটি অ্যাম্বুলেন্সে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। অগ্নিসংযোগে যানবাহনগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৬২টি বাস, ৪৪টি ট্রাক, ২৩টি কাভার্ড ভ্যান, ৮টি মোটরসাইকেল ও ৩২টি অন্যান্য গাড়ি। তবে বাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর তাৎক্ষণিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

তিনি আরো বলেন, গাড়িতে আগুন লাগার তথ্য পেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করেন। কিন্তু তাৎক্ষণিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয় না। কারণ গাড়ির মালিক সেখানে উপস্থিত থাকে না। সুতরাং কোন গাড়ির কত দাম কিংবা ক্ষতির পরিমাণ কত, সেটি জানা সম্ভব নয়।

তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি জানিয়েছে, হরতাল ও অবরোধে পরিবহণ খাতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এই হিসেবে গত ২৪ দিনে প্রায় ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এটি শুধু পরিবহণ খাত সংশ্লিষ্ট ক্ষতি। এর বাইরে পণ্য পরিবহণ ও মানুষের চলাচল খাতেও আরো বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এসব খাতে প্রতিদিনের ক্ষতি এক হাজার কোটি টাকা। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে কৃষিপণ্যে। পণ্য পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এদিকে ঝুঁকি নিয়ে পরিবহণ চালাতে গিয়ে ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকরা। ট্রাকপ্রতি গড়ে ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে ভাড়া। এতে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলে একদিকে কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি ও জামায়াত ইসলামসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ডাকা অবরোধে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার দশম দফা অবরোধের শেষ দিনে বৃষ্টির মধ্যে রাজধানীর শাহবাগ ও মতিঝিলে দুটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বাসে আগুন দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিশেষ বোমা। অন্যদিকে গত ৩০ নভেম্বর দিশারী পরিবহণের একটি বাসের পেছনের সিটে ধোঁয়া উড়তে দেখেন যাত্রীরা। সিটের দিকে বোমাসদৃশ সন্দেহজনক বস্তু থেকে ধোঁয়া দেখতে পেয়ে দ্রুত সেতুর সিঁড়িতে নেমে যান যাত্রীরা। বাসের কন্ডাক্টর বিষয়টি লক্ষ্য করে যাত্রীবিহীন খালি গাড়িটি নয়াবাজার ঢালে পুলিশ চেকপোস্টের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। কোতোয়ালি থানার ওসি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে বোম ডিসপোজাল ইউনিট, সিটিটিসি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। সিটিটিসির বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের একটি বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ওই বাসের সামনে থেকে পেছনের দিকে ষষ্ঠ সারির বসার সিটের নিচে থাকা একটি বিশেষ বোমা উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করে।

গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মতিঝিল শাপলা চত্বরের কাছে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন লাগানো হয়। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, বাসটির পেছনের সিটে আগুন লেগেছিল। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগে বাসটির চালক ও চালকের সহকারীরা তা নিভিয়ে ফেলেন।

গত ২৮ অক্টোবর বিকাল ৪টায় বিএনপি-জামায়াতের সমাবেশে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৩০০ জন অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী বিআরটিসি মতিঝিল আন্তর্জাতিক বাস ডিপোতে অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এ বিষয়ে পরের দিন রোববার সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো সরকারি পরিবহণ সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সমাবেশ ও হরতালের দুই দিনে বাস ডিপোতে হামলা, বাসে ভাঙচুর-আগুনের ঘটনায় ৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ডাকা দশম দফা অবরোধের শেষ দিন ছিল গত বৃহস্পতিবার। সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং দলের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে গত ২৯ অক্টোবর থেকে কখনো অবরোধ, কখনো হরতালের কর্মসূচি দিয়ে আসছে বিএনপি। একই ধরনের কর্মসূচি দিয়ে আসছে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোট। কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় নির্বাচন সামনে এলেই মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ে। আগুন সন্ত্রাসের খেলায় ব্যস্ততম শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাসে আগুন দেওয়া হচ্ছে। হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবহণ খাতে। গণ ও পণ্য পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মানুষের চলাচল যেমন কমে গেছে, তেমনি পণ্য পরিবহণও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি। হরতাল-অবরোধের কারণে যানবাহন চলাচল কম করায় বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের চলাচলে খরচ বেড়েছে। একদিকে তাদের আয় কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে খরচ। ফলে জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সম্প্রতি চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি হোসেন খালেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অবরোধে নাশকতার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে পরিবহণ খাত। ফলে পরিবহণ ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা পরিবহণ শ্রমিকরা। এ খাতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে কমবেশি সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবহণ খাতের বিষয়ে ঢাকা বাস মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক সাদমানী খন্দকার বলেন, হরতাল-অবরোধে প্রচুর যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা সবার কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নিয়ে তালিকা তৈরি করছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত