গরুর মাংসের দাম নিয়ে চলছে নাটকীয়তা

রাজধানীর বাজারে হরেকরকম দামে মিলছে মাংস

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

রমজান মাসে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয় সিটি করপোরেশন। অথচ এখনো রমজান উপলক্ষ্যে দাম নির্ধারণ করা হয়নি। অথচ ব্যবসায়ীরা নিজেরাই দাম নির্ধারণ করে দিয়ে একটা তামাশার জন্ম দিয়েছেন। ৬০০ টাকার কম থেকে শুরু করে ৮০০ টাকাও ওপর পর্যন্ত দামে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে রাজধানীতে। ফলে ক্রেতারা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। মাংস বিক্রেতাদের সঙ্গে তাদের তর্কাতর্কি হচ্ছে। ক্রেতারা গণমাধ্যমের খবরের বরাত দিয়ে গরুর মাংস কিনতে চাইলেও বিক্রেতারা তাতে সায় দিচ্ছে না। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যেকার এই সংঘাতকে দূর করবে তা নিয়েও চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করা হবে বলে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। কোথাও তারচেয়েও বেশি। এ নিয়ে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের মাংস ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডার খবর পাওয়া গেছে। মাংস বিক্রেতা প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম চান ৭০০ টাকা। অথচ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে ক্রেতা জেনেছেন চলতি মাসে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম থাকবে ৬৫০ টাকা। মূলত গরুর মাংসের দাম কেন্দ্র করেই বাকযুদ্ধে জড়ান ক্রেতা-বিক্রেতা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, যারা গরু কিনে বা মাংস কিনে এনে স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করছে তারাই জানে ৭০০ টাকায় বিক্রির পরও লোকসান হচ্ছে। এর চেয়ে কম দামে বিক্রি করার কোনো উপায় নেই আমাদের। বেশি দামে কিনে এনে ৬৫০ টাকায় মাংস বিক্রি করলে আমাদের আর ব্যবসা করা লাগবে না। গরুর মাংসের দাম নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে ‘ধোঁয়াশা’ চলছে। গত ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানী ঢাকায় ৬৫০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি হবে।

মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মোর্তজা মন্টু জানান, বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীতে ১ মাসের জন্য ৬৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি মাসে গরু কেনাকাটার ওপর নির্ভর করে দাম নির্ধারণ করা হবে। ১ মাস পর আবার বসে দাম পুনরায় নির্ধারণ করা হবে।

একই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, আগামী একমাস শর্তসহ ৬৫০ টাকা করে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা একমাস পর চেষ্টা করব, যেন এটিকে কমিয়ে ৬০০ টাকা করা যায়। আমাদের ভোক্তার চাহিদাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। গরুর খামারিরা যদি দাম কমায় তাহলে গরুর মাংসের দাম কমানো সম্ভব। ১ কেজি মাংসের মধ্যে ৭৫০ গ্রাম মাংস ২০০ গ্রাম হাড্ডি ও ৫০ গ্রাম চর্বি থাকতে হবে। ভোক্তারা চাইলে তারা আলাদা করে মেপে তাদের মাংস ক্রয় করতে পারবেন। তবে গতকাল ছুটির দিনে মাংস কিনতে আসা লোকজন জানান, খবরে শুনেছি মাংসের দাম থাকবে ৬৫০ টাকা কেজি। কিন্তু বাজারে এসে সত্যতা মিলছে না। সব দোকানেই তারা ৭০০ টাকা আবার ৭২০ টাকা করে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি করছে। দোকানিকে জিজ্ঞেস করলে বলছেন খবরে তো কত কিছুই দেখায়, আমাদের কেনা দাম বেশি, তাই ৭০০ টাকার কমে আমরা বিক্রি করতে পারছি না।

ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আসলেই যদি দাম নির্ধারণ করা হয়, তাহলে বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যারা বেশি দামে বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নইলে আমাদের মতো সাধারণ ক্রেতাদের জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা বেশি দাম আদায় করবে। দাম নির্ধারণের পরও কেন বেশি দামে গরুর মাংস বিক্রি করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে একজন মাংস বিক্রেতা বলেন, ৭০০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। তবুও আমাদের লোকসান হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কেনা দাম পড়ছে বেশি, গরু কিনে আনা, কর্মচারী, দোকান ভাড়া সব মিলিয়ে অতিরিক্ত খরচ পড়ে যায়। এই অবস্থায় ৬৫০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করলে লস হয়ে যাবে অনেক। যারা দাম নির্ধারণ করেছে, তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিছুটা দাম কমিয়ে বর্তমানে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। কিছুদিন আগেও আমরা ৭৮০ টাকা বিক্রি করেছি। বর্তমানে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছি, এর চেয়ে কমে আমরা বিক্রি করলে লসে পড়ে যাব। মাংস বিক্রেতারা বলছেন, আগে আরও অনেক বেশি মাংসের দোকান ছিল, এখন তা কমে গেছে। এর কারণ গরুর কেনা দাম বেশি, যা মাংস করে বিক্রির সময় দাম পড়ে যায় অনেক বেশি। ফলে ক্রেতারা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল গরুর মাংস কেনা। এরই মধ্যে রাজধানীতে অনেক মাংসের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, কয়েকদিন আগেও আমরা ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করেছি। মাংস ব্যবসায়ী সমিতির নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গরুর মাংসের দাম ৬৫০ টাকা। কিন্তু আমাদের কেনা দাম বেশি পড়ে যায়, তবুও আমরা দাম কমিয়ে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছি। এতেও লস থেকে যাচ্ছে। গরুর দাম বাড়তি না হলে, পথে পথে খরচ কমে গেলে হয়তো গরুর মাংসের দাম আরো কমানো যাবে। বেশ কিছুদিন ধরে গরুর মাংসের দাম নিয়ে এক ধরনের তামাশা শুরু হয়েছে। বাড়তি দাম থেকে কমে কিছুদিন বিক্রি হলো। এরপর ব্যবসায়ীরা এক মাসের জন্য ৬৫০ টাকায় দাম বেঁধে দিলেন। বেঁধে দেওয়া দাম মাঝখানের কমে যাওয়া দাম থেকে বেশি। রাজধানীর বাজারগুলোতে কোথাও কোথাও ৫৯৫ থেকে ৬১০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছিল। আবার কোথাও ৭০০- ৭৫০ টাকা আবার কোথাও ৭৮০ টাকাও বিক্রি হচ্ছিল। এতে ক্রেতারা এক বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। গরুর মাংসের দাম সমন্বয়ে করতে গিয়ে গত রোববার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে মতবিনিময় সভায় বসে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেই সভায় মাংস ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় হট্টগোল করেন। সেদিন দাম সমন্বয় করা যায়নি। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, গত বুধবার বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি, বিডিএফএসহ সব পক্ষ গরুর মাংসের দাম ঠিক করবে এবং তা রোববারের মধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তরে প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও (বিটিটিসি) গরুর মাংসের বাজার যাচাই করবে। নির্দেশনার আলোকে গত বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাদেক অ্যাগ্রোর কার্যালয়ে মাংস উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) ও মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভায় গরুর মাংস ৬৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাজধানীর বেশ কিছু বাজারের ৬৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হতে দেখা গেলেও কেউ কেউ এখনো ৫৯৫ টাকা গরুর মাংস বিক্রি করছেন। যদিও এ সংখ্যা খুবই সামান্য। ৫৯৫ টাকা দরে গরুর মাংস বিক্রি করলে কখনো কখনো প্রতি গরুতে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা লোকসান হয় বলে জানান কোনো কোনো দোকানি জানান, এরপরও তারা গরুর মাংস বিক্রি করছেন ৫৯৫ টাকায়। তবে ৫৯৫ টাকায় যে মাংস বিক্রি করা হয়, তাতে মাংস, চর্বি ও হাড় একসঙ্গে মেশানো থাকে। গরুর মাংসের দাম যখন ৮০০ টাকা ছিল, তখন বিক্রি কমে গিয়েছিল। তখন দিনে দুই থেকে তিনটি গরু বিক্রি করা কঠিন ছিল। ফলে দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিতে মালিকের কষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু প্রতি গরুতে নির্দিষ্ট পরিমাণে লাভ থাকত। যদিও এ লাভে খরচ উঠত না। তবে দাম কমার পর বিক্রি বেড়ে যায় অনেক। দিনে ১০ থেকে ১৫টিরও বেশি গরু বিক্রি হতে থাকে। ক্রেতারা বেশি কিনতেন। তবে ৫৯৫ টাকায় মাংস বিক্রি করলে সব গরুতে আগের মতো লাভ পাওয়া যায় না। যাদের বিক্রি কম বা যাদের ক্রেতা কম, তারা লাভ করতে পারে না। এক কেজি মাংসে কী কী থাকবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে বিক্রেতারা মনে করছেন, নতুন দামে ক্রেতারা ভালো মানের মাংস পাবেন।