বাজারে জোরালো অভিযান

সরবরাহ বাড়ায় দাম কমছে পেঁয়াজের

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে, এরইমধ্যে ভারতীয় পেঁয়াজের রপ্তানি বন্ধের খবরে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঘণ্টা ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের কেজি ১২০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি শুরু করে। এতে ক্রেতারা হতাশ, ক্ষুব্ধ আর অসহায় হয়ে পড়েন। তবে গত সোমবার পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান জোরদার করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এতে পেঁয়াজের কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা কমেছে।

সরেজমিন রাজধানীর শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ি, মালিবাগসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা বিক্রেতাদের সামনে নতুন ও পুরাতন দেশি পেঁয়াজের পসরা নিয়ে বসে আছেন। এসব বাজারে সাধারণত খুচরা দরে বেচাকেনা চলে। এক দিনের ব্যবধানে বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি কমবেশি ৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মগবাজারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, পুরোনো দেশি পেঁয়াজ কিনতে প্রতি কেজি অন্তত ২০০ টাকা দাম দিতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও পেঁয়াজ ২২০ টাকায় বিক্রির খবরও পাওয়া গেছে। আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের দাম পড়ছে প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। আর চীন থেকে আসা বড় আকারের পেঁয়াজের দাম ১২০ থেকে ১৩০ টাকা।

রাজধানীর খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। এজন্য পাইকাররা দেশি পেঁয়াজ ছাড়ছেই না। কারওয়ান বাজার ও শ্যামবাজারে পেঁয়াজ মণপ্রতি ৮০০-১০০০ টাকা বেড়ে যায়। রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সুজর মিয়া বলেন, ভারতীয় পেয়াঁজ বন্ধ শুনেই বাজারের এ অবস্থা, আগের দিনেও দেশি পেঁয়াজ ১২০ টাকা ছিল, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আড়তে পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকা হয়ে যায়, সেজন্য বাধ্য হয়েই খুচরা পেঁয়াজ ২২০ টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার আড়তে পেঁয়াজ কেজিতে ৫০ টাকা কমিয়েছে। ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথপোকথনের মাঝেই আরেকজন ক্রেতা এলেন এক কেজি পেয়াঁজ নিতে। কিন্তু দাম শুনে তিনি শেষ পর্যন্ত আধাকেজি পেয়াঁজ কিনলেন। এখানে দাম বেশি বলে কোনো কোনো দোকানি পেঁয়াজ তোলেননি দোকানে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাওরান বাজারের এক আড়তদার বলেন, আমরা পার্টির কাছ থেকে মাল নেই। আমরা হলাম দ্বিতীয় পর্যায়। পার্টি এলসি দিয়ে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে, তাদের কাছ থেকে আমরা কিনে নেই। এবার আমাদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে চতুর্থ ধাপে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছায়। প্রতিটি ধাপেই পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে।

চট্টগ্রাম: পেঁয়াজের মূল্য, মজুদ পর্যবেক্ষণ ও পাইকারি থেকে খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ছয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে নগরের বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। জানা গেছে, নগরের আগ্রাবাদের চৌমুহনী এলাকার কর্ণফুলী মার্কেটে এ অভিযান পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম। তিনি সেখানের ৫০টির অধিক দোকানদারকে সর্তক করেন। বাজারে ২ কেজির বেশি পেঁয়াজ একজন ক্রেতাকে বিক্রি না করতে অনুরোধ করেন। খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের বর্তমান মূল্য অনুযায়ী ১২০ টাকার বেশি বিক্রি না করতে সর্তক করেন। নগরের ২নং গেটের কর্ণফুলী বাজারে অভিযান পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক।

বাজারে ক্রয়-বিক্রয় রসিদ অসংরক্ষণ ও উচ্চমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির দায়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ সাকিব স্টোরকে ৫ হাজার, ফিরোজ স্টোরকে ৫ হাজার, আবদুল হাকিম স্টোরকে ১০ হাজার, খাজা স্টোরকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এছাড়া চাক্তাইয়ে অভিযান পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাকিবুল ইসলাম। তিনি এক মামলায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। পাহাড়তলী বাজারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিমাদ্রী খীসা অভিযান পরিচালনা করে ৮ মামলায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন।

নগরের কাজীর দেউড়ি বাজারে অভিযান পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফেরদৌস আরা। অভিযানে ৩ মামলায় ৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পেঁয়াজের মূল্য ও মজুদ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ছয়জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে নগরের বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। বাজারে জরিমানার পাশাপাশি তাদের সর্তক করা হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জের অন্যতম বড় আড়ত ঝিটকায় দুই দিনের ব্যবধানে পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৫০-৬০ টাকা কমছে। এছাড়া খুচরা বাজারেও কমেছে পেঁয়াজের দাম। ওই আড়তে প্রতিদিন ১০০-১২০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে বলে জানান আড়তদাররা। বর্তমানে পুরোনো পেঁয়াজ চার হাজার থেকে চার হাজার ৪০০ টাকা মণ এবং নতুন পেঁয়াজ তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাসুম রোমান এন্টারপ্রাইজের মালিক রজ্জব আলী বলেন, বেশি পেঁয়াজ কিনিনি। ৭০ থেকে ৮০ মণ পেঁয়াজ কিনেছি। দাম কমছে, আবার লোকসানের ভয় আছে। এদিকে নতুন পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়েছে। অন্যদিকে খুচরা বাজারেও পেঁয়াজের দাম কমেছে। ঝিটকা বাজারের খুচরা পেঁয়াজ ব্যবসায়ী রানা বলেন, পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৬০-৭০ টাকা কমেছে। নতুন পেঁয়াজ খুচরায় ৯০-১০০ বিক্রি করা যাচ্ছে।

জানা গেছে, বাসাবাড়িতে চীনা পেঁয়াজের ব্যবহার কম। তাই ক্রেতাদের অনেকে বাজারে নতুন আসা মুড়িকাটা পেঁয়াজের দিকে ঝুঁকেছেন। এই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায়। শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মাজেদ বলেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসায় বাজারে পেঁয়াজের দাম সপ্তাহ-দশ দিনের মধ্যে নেমে আসবে। দেশি পেঁয়াজ আসা শুরু হলে আমদানি করা পেঁয়াজের চাহিদা পড়ে যায়।

বগুড়া: একদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা কমছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে, তাই দাম কমে গেছে। রাজাবাজার, ফতেহ আলী বাজার ও রেললাইনের উপরের বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, পাইকারিতে নতুন দেশি পেঁয়াজ ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে; যা গত দুদিন আগেও ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া পুরোনো দেশি পেঁয়াজ ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি দরে; যা গত দুই দিন আগে ছিল ১৯০ থেকে ২০০ টাকা।

পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আব্দুর রশীদ বলেন, এক রাতের মধ্যে দাম বেড়েছিল। গতকাল সরবরাহ বেড়েছে তাই কমেছে। কাঁচামালের দাম এভাবেই ওঠা-বাড়া করে। তবে এতে আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। গত রোববার বেশি দামে কেনা পেঁয়াজ সোমবার কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। বগুড়ার রাজাবাজার আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ ও দেশীয় পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকার কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল। দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়লে দাম আরো কমে আসবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জুন থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ৭ দশমিক ৫ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। তবে আমদানির অনুমোদন দেওয়া আছে ১৯ দশমিক ৯০ লাখ টন পেঁয়াজের। ভারত ছাড়া আরও ৯টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা যাবে। এসব দেশ হলো চীন, মিসর, পাকিস্তান, কাতার, তুরস্ক, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয় প্রায় ৮ লাখ টন। এ ছাড়া এ বছর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার টনের মতো। মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ তিন থেকে সাড়ে তিন মাস বাজারে থাকে। এরপর মূল পেঁয়াজ আসা শুরু হবে, যার উৎপাদন হতে পারে ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা কমাতে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত শনিবারের অভিযানে অনিয়মের অভিযোগে সারা দেশে ১৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত কিছু মজুতদারকে এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। সারা দেশে বাকি মজুতদারদেরও চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চলছে। এসব মজুতকারীকে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।