কোণঠাসা হয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। চারদিক থেকে বিভিন্ন জায়গা শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর আসছিল। বীর সন্তানরা তাদের মূল লক্ষ্য রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। সারা দেশের বেশিরভাগ জায়গায় উড়তে থাকে লাল-সবুজের পতাকা। একাত্তরের এদিন সন্ধ্যায় দক্ষিণ-পূর্ব, পূর্ব-উত্তর ও উত্তর দিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনী ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠের সমবেত হয়। সপ্তম নৌবহরের স্থল সংযোগ প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য স্থান চট্টগ্রাম উপকূলভাগও তখন মিত্র বাহিনীর প্রায় দখলে চলে আসে। সারাদিন ধরে ভারতীয় জঙ্গি বিমান ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থান স্থল, বাঙ্কার, কমান্ড কেন্দ্র, সামরিক উপদপ্তরের ওপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়।

মুক্তিযোদ্ধারা যখন প্রিয় দেশকে শত্রুমুক্ত করে বিজয়ের একদম দ্বারপ্রাপ্তে চলে এসেছিল, তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালরা বেপরোয়া হয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, যা ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের আগ পর্যন্ত অব্যাহত রাখে। কিন্তু পুরোপুরি কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনী শুধু নিশ্চিত হতে চাইছিল যে, আত্মসমর্পণের সময় তাদের হত্যা করা হবে না। কারণ, পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে রওনা দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর যখন বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টার দূরত্বে গভীর সমুদ্র এসে অবস্থান করছিল, তখন ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় ১৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে, যার ফলে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত যে বিদেশি সাহায্যটুকু পাওয়ার আশা করেছিল তা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।

আবশেষে পাকিস্তানি সমরাধি নায়ক লে. জেনারেল নিয়াজীর অনুরোধে একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে পরের দিন সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়। একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রামে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে রাউজান হয়ে শহরের দিকে পালিয়ে যায়। এর ফলে শত্রুমুক্ত হয় রাঙ্গুনিয়া। একই দিনে শত্রুমুক্ত হয় পার্বতীপুর, নীলফামারী, গোয়ালন্দ। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। সরারাত ধরে চলতে থাকে যুদ্ধ। অন্যদিকে বগুড়া ও পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। এ বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সাবসেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে। তার গুণাবলীর কারণে খুল অল্প সময়ে তিনি সবার শ্রদ্ধাভাজন হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দিনের বেলায় অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন আর রাতে গেরিলাদের সঙ্গে অপারেশনে বের হতেন। রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জ ঘাঁটি হানাদারমুক্ত করার যুদ্ধে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাহনন্দা নদী পার হয়ে যখন তিনি একের পর এক শত্রু বাঙ্কার দখল করে জীবনের পরোয়া না করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ শত্রুর একটি গুলি বিদ্ধ হয় তার কপালে এবং তিনি শহীদ হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার অন্তর্গত ঐতিহাসিক গৌড়ের সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন জাতির এই বীর সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গির।