বাস পেরিয়ে এবার ট্রেনে নাশকতা

নিহত এক, আহত ১০

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

আসছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোট যতই ঘনিয়ে আসছে দেশজুড়ে ততই নাশকতা-সহিংসতা বাড়ছে। বিভিন্ন যানবাহন ও মালবাহী গাড়িতে চোরাগোপ্তা হামলা করছে ভোটবিরোধীরা। মাঠের রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি হরতাল-অবরোধের নামে কমবেশি প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে আগুন ও ভাঙচুর করছে। এবার বাস পেরিয়ে ট্রেনে নাশকতা করেছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা। নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা বাড়ায় উদ্বগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দ্বাদশ জতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে অব্যাহতভাবে সহিংসতার দিকে ঝুঁকছে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠন। এ অবস্থা বজায় থাকলে দিন যত গড়াবে পরিস্থিতি ততই অবনতির দিকে যেতে পারে।

বিএনপির ১১তম অবরোধ গত মঙ্গলবার থেকে বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ছিল। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বাস পোড়ানো ও রেললাইন কেটে ফেলা হয়েছে। গতকাল বুধবার ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের গাজীপুরের বনখড়িয়া (চিলাই নদীর) ব্রিজে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা এলাকার মুরগি ব্যবসায়ী আসলাম (৩৫) মারা গেছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। গাজীপুরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে নাশকতা রয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কমিটি করেছে রেলওয়ে এবং আরেকটি করা হয়েছে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

জানা যায়, ঢাকামুখী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি গাজীপুরের ভাওয়ালের কাছে বনখড়িয়া এলাকায় লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনার পর প্রায় আধা কিলোমিটার জনবসতিশূন্য এলাকায় ২৫০ মিটারজুড়ে এলোমেলো পড়ে থাকে সাতটি বগি। ইঞ্জিন ও চারটি বগি পড়ে ছিল রেললাইনের পূর্ব দিকে। বাকি বগিগুলো লাইনের পশ্চিমে। ঘটনাস্থলের বিশাল এলাকা ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় উদ্ধারকারী ট্রেন।

দুর্ঘটনাস্থলের পাশের ভাওয়াল গাজীপুর এলাকার বাসিন্দা ও অটোরিকশাচালক মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘুমাইয়া ছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙে। টর্চলাইট নিয়া বাইর হইয়া শুনি কান্নাকাটির আওয়াজ। কাছে গিয়া দেখি একদম কেয়ামত হয়ে গেছে। ট্রেনের বগিগুলা এলোমেলো হইয়া পইরা আছে। যাত্রীদের চিৎকারে তহন আশপাশের শত শত লোকজন দৌড়াইয়া আসে। যে যার মতো উদ্ধার করে।’ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ইন্সেপেক্টর আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গত ৪৬ দিনে দুর্বৃত্ত কর্তৃক মোট ২৭৮টি অগ্নিসংযোগের (কয়েকটি স্থাপনাসহ যানবাহনে) সংবাদ পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এতে ২৭৪টি যানবাহন ও ১৫টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অগ্নিসংযোগকৃত যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ১৭০টি বাস ১৭০টি, ৪৫টি ট্রাক, ২৩টি কাভার্ড ভ্যান, আটটি মোটরসাইকেল ও ২৮টি অন্যান্য গাড়ি।

রেললাইন কাটায় বগি লাইনচ্যুতের ঘটনার বিষয়ে গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ডিএডি) আব্দুল্লাহ-আল আরেফিন জানান, দুষ্কৃতিকারীরা রাতের কোনো একসময় গ্যাস কাটার দিয়ে লাইন কেটে রাখে। রাত ১১টায় মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি গাজীপুরের বনখড়িয়া চিলাই ব্রিজে আসামাত্রই ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি রেল পথের পাশের নিচু জমিতে পড়ে যায়। রেল লাইনের পাশে জঙ্গল থেকে ১২ কেজি সিলিন্ডার গ্যাসে বোতল উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল ফাতে মো. সফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী শফিকুল আলমসহ রেল ও ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা অস্বাভাবিক কিছু না। অতীতেও জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচন সামনে এলে সব দলই তাদের শক্তিতে মেতে ওঠে। প্রতিপক্ষের প্রচারণাকে বাধাগ্রস্ত করে। নির্বাচনের আগে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনি প্রচারণা করবে, এ সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, বিএনপি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, মাঠে আন্দোলনে নামছে। সহিংসতার সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতির সঠিক চর্চার অভাবে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে এসে রাজনীতির সঠিক চর্চা করতে হবে, তা না হলে সহিংসতা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।

গত দুই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশ হয়েছে। রাজধানীতে কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধ করে পিকেটিং হয়েছে। তবে আজকে (বৃহস্পতিবার) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও শনিবার মহান বিজয় উপলক্ষ্যে বিএনপির কর্মসূচি রয়েছে। আগামী রোববার থেকে ফের দলটি নতুন করে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে যেতে পারে। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ প- হওয়ার পর থেকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আগে ১১তম দফায় ২৩ দিন অবরোধ এবং তিন দফায় চার দিন হরতাল করেছে। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা জামায়াতে ইসলামী ও এবি পার্টি একই কর্মসূচি পালন করছে। একাদশ দফা অবরোধের দ্বিতীয় দিনে রাজধানীর আরামবাগ, ফকিরাপুল, মগবাজার, সেগুনবাগিচা, সেন্ট্রাল রোড, বনশ্রী, রামপুরা, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, পল্লবী, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও ও ধানমন্ডিতে মিছিল করে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। প্রেসক্লাব, কাকরাইল ও বিজয়নগর এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি ও ১২ দলীয় জোট। বিজয়নগরে বিজয়-৭১ চত্বরে কর্মসূচি পালন করে এবি পার্টি। এদিন বিক্ষোভ মিছিল করে গণফোরাম (মন্টু) ও গণঅধিকার পরিষদের দুই অংশ। অবরোধের পক্ষে রাজধানীর পান্থপথ, মিরপুর ৬০ ফিট আমতলা বাজার, আবদুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ, মগবাজার, কাফরুল, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, শনির আখড়া, হাজারীবাগ, খিলগাঁও এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে ঝটিকা মিছিল-পিকেটিং করেছে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ জামায়াত ইসলাম।