রিজার্ভে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি যুক্ত হবে কাল

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশংসায় আইএমএফ

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের জন্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের প্রস্তাব আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বোর্ড সভায় অনুমতি পেয়েছে। গত মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে এ অনুমতি দেওয়া হয়।

ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ডলার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভে যোগ হবে আগামীকাল। গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামীকালের মধ্যে আমাদের অ্যাকাউন্টে (হিসাব) সে অর্থ যোগ হবে।

আইএমএফ চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোট ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় এ ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ অনুমোদনের পরপরই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ছাড় করে সংস্থাটি। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে পুরো অর্থ দেওয়ার কথা রয়েছে।

ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য গত জুনভিত্তিক বিভিন্ন সূচকে শর্ত পালনের অগ্রগতি দেখতে ৪ অক্টোবর আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় আসে। মিশনের নেতৃত্ব দেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। মিশনটি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সঙ্গে টানা ১৬ দিন বৈঠক করে।

ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাংলাদেশকে দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের প্রশংসা করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। একই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে মুদ্রানীতির রাশ টেনে ধরার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।

এর সঙ্গে সহায়ক নীতি হিসেবে নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি ও মুদ্রার বিনিময় মূল্যের ক্ষেত্রে আরো নমনীয় হওয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি। বাইরের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে এসব পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিয়েছে। মুদ্রানীতির কাঠামো আরো আধুনিকায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের প্রশংসা করেছে আইএমএফ।

সংস্থাটি মনে করে, মুদ্রানীতি আধুনিক হলে তার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির প্রভাব জোরদার হবে। মুদ্রার একক বিনিময় হার গ্রহণের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে আইএমএফ এ ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে আরো নমনীয় হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে। অর্থনীতির বাইরের ধাক্কা মোকাবিলায় এটি জরুরি।

বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি হিসাবে ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ মার্কিন ডলার ছাড় করেছে আইএমএফ। গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় কিস্তির ঋণের অর্থ দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। কিস্তি ছাড়ের পর দেশের অর্থনীতির মূল্যায়ন করে সংস্থাটি যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে তারা এসব কথা বলেছে। বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)-এ তিনটি ভাগে ঋণ দিচ্ছে আইএমএফ। এবার ইসিএফ বা ইএফএফের আওতায় ৪৬ কোটি ৮৩ লাখ ডলার এবং আরএসএফের আওতায় ২২ কোটি ১৫ লাখণ্ড সব মিলিয়ে ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ঋণ ছাড় করেছে আইএমএফ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আর্টিকেল ৪’ শীর্ষক পরামর্শ সম্পন্ন করেছে তারা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৬ শতাংশ প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমতির দিকে থাকলেও রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। কঠোর মুদ্রানীতি ও নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতির কল্যাণে মূল্যস্ফীতির হার আগামী অর্থবছরের শেষ নাগাদ ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে থাকবে। আইএমএফ মনে করে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক বিনিয়োগ জরুরি। করনীতি সংশোধন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কর-রাজস্ব বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে সংস্থাটি। ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয় করার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আরো দক্ষতার সঙ্গে আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্ব দিয়েছে তারা। উন্নয়নের জন্য দেশে অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এ বাস্তবতায় আইএমএফ মনে করে, আর্থিক খাতের সংস্কার জরুরি। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি পুঁজি পুনরুদ্ধারে বিশেষ কৌশল প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে।

সংস্থাটির পরিচালকরা এ বিষয়ে একমত যে ব্যাংক খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করা, শাসনব্যবস্থার উন্নতি ও দেশীয় পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা গেলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার তাগিদ দিয়েছে তারা। সংস্থাটি মনে করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা ব্যবস্থা উন্নত হলে তা আর্থিক খাতের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের তহবিলও পাওয়া যাবে।

তারা আরো মনে করে, দেশের অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই নানা সংস্কার প্রয়োজন; উচ্চমধ্যম আয়ের কাতারে পৌঁছাতে গেলে এসব জরুরি। একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে শ্রমশক্তিতে বাণিজ্য উদারীকরণ, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন, শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী বাহ্যিক আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইএমএফের পরিচালকরা মনে করেন, এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সংস্থাটির শর্ত পরিপালনে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে পথচ্যুত হয়নি। এ ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ যেসব সংশোধনমূলক ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে এবং জরুরি সংস্কার বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে, তাকে স্বাগত জানিয়েছে বহুপক্ষীয় এ সংস্থাটি। আইএমএফের পরিচালকরা জানান, স্বল্পমেয়াদি নীতি প্রণয়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতির রাশ টানা এবং বাইরের ধাক্কা মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি। সেটা করার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের ওপর যেন তার প্রভাব না পড়ে। শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার গুরুত্ব তুলে ধরেছে আইএমএফ। উল্লেখ্য, এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ।

চলতি মাসে রিজার্ভে যুক্ত হবে ১.৩১ বিলিয়ন ডলার : চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে ১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে ৬৮৯ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার আসছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৯০ মিলিয়ন ডলারসহ অন্যান্য সোর্স থেকে এই অর্থ আসবে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবা উল হল হক এ কথা বলেন। মেজবা উল হক বলেন, বর্তমানে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু উপরে। আইএমএফ এডিবি, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন সোর্স থেকে আসা ১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তবে জানুয়ারি মাসে আকুর এক বিলিয়ন ডলার দায় পরিশোধ করতে হবে।