হরতাল ডাকে কারা কারা করে নাশকতা!

* ট্রেনে আগুনে মা-শিশুসহ নিহত ৪ * গুলিস্তানে যাত্রীবাহী বাসে আগুন

প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধে চলন্ত বাসের পর ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে মরছে যাত্রীরা। তবে নিহতের দায় অস্বীকার করছে বিএনপি। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নিহতের দায় বিএনপিকে দিচ্ছে। অন্যদিকে নাশকতাকারীদের ধরতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

জানা গেছে, বাসে ও ট্রেনে আগুন দেওয়ার পেছনে কারা জড়িত তা নিয়ে মানুষের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, আগুনের ঘটনার পর বরাবরই দুর্বৃত্তদের দায়ী করছে বিভিন্ন সংস্থা। তবে এই দুর্বৃত্তরা কারা, কারা নাশকতা করছে, সেটি খুঁজে বের করার দাবি তুলেছে বিএনপি। এছাড়া রাজধানীর গুলিস্তান জিপিও এলাকায় একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

গতকাল ভোরে রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনায় মা ও শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া রাজধানীর গুলিস্তানে একটি বাসেও আগুন দেয়া হয়েছে। এর আগেও গাজীপুরে রেললাইন উপড়ে ফেলে ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনায় একজন নিহত ও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে ট্রেনে হামলা ও যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল করীর রিজভী গতকাল ভোরের তেজগাঁও রেলস্টেশনে ট্রেনের বগিতে আগুন দেয়ার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচার দাবি করেছেন। তিনি এই ঘটনাকে কলঙ্কময় বলেও অভিহিত করেছেন।

অন্যদিকে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, যারা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে তারাই ট্রেন ও বাসে আগুন দিয়েছে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে- আগুন দেয়ার ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত। তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এই ধরনের নাশকতার সঙ্গে হরতাল-অবরোধকারীরা জড়িত থাকার অভিযোগ করলেও বিএনপি তা অস্বীকার করছে। রাজনীতির মাঠে দোষারোপের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আসল অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে না।

রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে আসা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেনের তিনটি বগিতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে এক নারী ও তার শিশুসন্তানসহ ওই ট্রেনের চার যাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহত মায়ের নাম নাদিরা আক্তার পপি (৩২) ও তার ৩ বছরের ছেলে ইয়াছিন। তবে বাকি দুজন পুরুষ, তাদের পরিচয় জানা যায়নি। মরদেহগুলো উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শাজাহান শিকদার জানিয়েছেন, আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট গিয়ে আগুন নির্বাপণ করে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটির তিনটি বগিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন যাত্রীদের বরাত দিয়ে জানান, ট্রেনটি বিমানবন্দর স্টেশন পার হয়ে খিলক্ষেতে এলে বগিগুলোতে আগুন দেখতে পান যাত্রীরা। তারা চিৎকার শুরু করলে শুনতে পেরে চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান। আগুন নেভানোর পর ট্রেনটি কমলাপুর রেলস্টেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানায় পুলিশ।

এর আগে ১৩ ডিসেম্বর ভোরে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রহল্লাদপুর ইউনিয়নের বনখড়িয়ার চিলাই ব্রিজ-সংলগ্ন এলাকায় দুর্বৃত্তরা রেললাইন কেটে ফেলায় ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ওই দুর্ঘটনায় এক যাত্রী নিহত এবং ট্রেনের লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টারসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন।

তেজগাঁওয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন : তেজগাঁও রেলস্টেশনে ট্রেন দুর্ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলেছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। রেলভবনে ‘সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত রাজনৈতিক কারণে ট্রেনে নাশকতা সৃষ্টি’ বিষয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে গতকাল তিনি এ কথা জানান। দুর্ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, পুরো ঘটনা তদন্ত না করে নির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ঘটনা হওয়ার কারণ সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, কেউ যাত্রী হয়ে ট্রেনে উঠলে নিরাপত্তা দেওয়া তো রেলের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। বিএনপি-জামায়াত ২০১৩-১৪ সালেও একই ঘটনা ঘটিয়েছে। বাসের বদলে ট্রেনকেই এখন প্রধান হাতিয়ার করা হচ্ছে। পরিকল্পিত দুর্ঘটনা ঘটাতে ফিশপ্লেট খুলে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতেই পারে কিন্তু সহিংসতা করতে পারে না বলে মন্তব্য করেন রেলপথমন্ত্রী সুজন। তিনি বলেন, কর্ণফুলী সেতু থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথের অনেক যন্ত্রাংশ চুরি করার নামে খুলে নেওয়া হয়েছে যেন ট্রেন চলাচল করতে না পারে। তারা এ ধরনের নাশকতা ঘটিয়ে মনে করছে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা করা সম্ভব। যদিও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে কিন্তু তারা কর্মসূচি না দিলে তো এটা হতো না।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি এ ঘটনায় আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে বলেছেন, ‘যারা ট্রেনে আগুন দিয়ে চার যাত্রীর প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দিলো, তারা নিঃসন্দেহে মানুষ নামের কলঙ্ক।’ গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।

বিবৃতিতে রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘মহল বিশেষের প্রশ্রয় ব্যতিরেকে এ ধরনের মানবতাবিরোধী কাজ করা সম্ভব নয়। মূলত চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে জনদৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এটি কুটচাল কি না, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে।’

এটিকে ‘সুপরিকল্পিত নাশকতা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নাশকতাকারীরা মানবসভ্যতার শত্রুপক্ষ, এরা মানবজাতিকেই অস্তিত্বহীন করতে চায়। এ ধরনের লোমহর্ষক ও পৈশাচিক কাজ কেবলমাত্র অবৈধ ও গণবিরোধী শক্তির মদতেই হওয়া সম্ভব। আমি এই বর্বরোচিত ও হৃদয়বিদারক ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি, ধিক্কার ও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা এই ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।’

বিএনপির এই নেতা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেনে আগুনে হতাহতের ঘটনায় জড়িত দুষ্কৃতকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর আহ্বান জানিয়ে নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি এবং আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করেন। তবে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে নিরাপদ রেলযাত্রাকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো যে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে, এ সময়টাতে রেল সম্পর্কিত সহিংসতা বাড়ছে। বর্তমানে রেল চলাচলে হুমকি তৈরি হয়েছে।

রেলপথে সরাসরি আক্রমণের প্রথম ঘটনা ঘটে গত ১৬ নভেম্বর। টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের দুটি কোচে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরপর ১৯ নভেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়িতে যমুনা এক্সপ্রেসে পরিকল্পিত নাশকতা করা হয়েছে। ২২ নভেম্বর সিলেটে উপবন এক্সপ্রেসে আগুন ধরানো হয়। ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে বিশফুট রেলওয়ে ট্র্যাক কেটে ফেলা হয়। এ দুই ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না হলেও বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন রেলপথমন্ত্রী। রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেনে নাশকতায় আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে দেখতে গিয়ে গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, হরতাল-অবরোধকারীরাই রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ট্রেনে আগুন দিয়েছে। রাজনৈতিক দলের লোকজন হরতাল ও অবরোধের নামে জনগণের জীবন-সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে। তেজগাঁওয়ের ট্রেনে আগুন সেই প্রক্রিয়ারই অংশ বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশ মনে করছে। তিনি বলেন, অবরোধ-হরতালকারীরা নাশকতা করছে। এর আগেও ট্রেনে আগুন দেওয়ার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তরা ধরা পড়েছে। গাজীপুরের রেললাইন কেটে ফেলা হয়েছিল। সেখানেও একজনকে হত্যা করা হয়েছে। আমি বলব, ট্রেনটিকে দুর্ঘটনার কবলে ফেলে একজনকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে যা ঘটছে, প্রতিটি ঘটনাকে আমি সরাসরি হত্যা বলতে চাই। যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, তারা হরতাল এবং অবরোধকারীদের একটি অংশ বলে মনে করছেন হাবিবুর রহমান।