ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন

ব্যর্থতার খাতায় যুক্ত হবে আরেকটি নাম

ব্যর্থতার খাতায় যুক্ত হবে আরেকটি নাম

বর্তমান সরকারকে এখন থেকে আর কোনো সহযোগিতা না করতে প্রশাসন ও দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। সেই সঙ্গে আগামী ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে দলটি। গত বুধবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, আমি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের তারেক রহমানের পক্ষে থেকে এ আহ্বান জানাচ্ছি। এ সময় মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে ভোট গ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান রিজভী। এছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারকে সব ধরনের কর, খাজনা, পানি, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল দেওয়া স্থগিত রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ব্যাংক খাতের মাধ্যমে সরকার অর্থ লুটপাটের কারণে ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কি না, সেটি ভাবার আহ্বান জানান বিএনপি এই জ্যেষ্ঠ নেতা। আগামী ৭ জানুয়ারির ভোট প্রতিহতের অংশ হিসেবে এসব কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যাদের ট্যাক্স ও সেবা খাতের যেমন বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল বাকি রয়েছে, সেসব বকেয়া আদায় করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, ট্যাক্স, বিল যাদের বাকি, ঋণ নিয়ে যারা পালিয়েছে, তাদের তালিকা করে আদায় করা হবে। কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান বকেয়া সব আদায় করতে। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ওবায়দুল কাদের।

এদিকে ওবায়দুল কাদের গত বুধবার বিকালে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে দেয়া বক্তব্যে বলেন, ‘বিএনপি এখন কী বলে? অসহযোগ আন্দোলন করবে। বানরে সংগীত গায় শিলা জলে ভাসে। সেরকম হলো না? এরা নাকি অসহযোগ আন্দোলন করবে? ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সরদার।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, ‘বিএনপি কি আছে? লাল কার্ড। নির্বাচনে আছে ১ হাজার ৮৯৬ জন। এই ১ হাজার ৮৯৬ জন ৭ জানুয়ারি সারা দেশে ৩০০ আসনে খেলবে। জোরদার খেলা হবে।’ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালাননি। তিনি ভোট করছেন এবং দেশেই আছেন- জানিয়ে কাদের বলেন, বিএনপি তো লালকার্ড পেয়ে এখন মাঠের বাইরে। তারা তো ফাইনাল খেলায় নেই, পালিয়েছে। নির্বাচনের পর নাকি সরকার পতন হবে। প্রস্তুত থাকুন সবাই। ওবায়দুল কাদের বলেন, এখন কী বলে? নির্বাচনের পরের পাঁচ দিনে সরকারপতন হয়ে চলে যাবে। কী বলেন, বিশ্বাস হয়? ভুয়া। বিএনপিই হলো ভুয়া। তাদের রাজনীতি, অবরোধ আজকের কর্মসূচি অগ্নিসন্ত্রাস ভুয়া। বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র রুখতে হবে একসঙ্গে। তিনি বলেন, আগুন নিয়ে খেলবেন না। আগুন নিয়ে খেললে নিজেরাই পুড়ে মারা যাবেন। এরা নেতানিয়াহু ও ইসরাইলি বাহিনীর চেয়েও নিষ্ঠুর। কী ঘটনা ঘটেছে তেজগাঁওয়ে। মা তার শিশুকে বুকে নিয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। কে করেছে? বিএনপি ও তার সন্ত্রাসীরা।

বিএনপি অনেক বছর ধরেই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে তারা সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করে। ফলে তারা নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। একদফা আন্দোলনের শুরুতে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ থাকলেও গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর পাল্টে যায় পরিস্থিতি।

প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হাসপাতালে হামলার পর প- হয়ে যায় বিএনপির মহাসমাবেশ। সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির সক্রিয় প্রায় সব নেতা এবং বিপুলসংখ্যক কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

যারা গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছিলেন, তারা সবাই গা ঢাকা দেন। ফলে সাময়িকভাবে হলেও বিএনপি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে পরিণত হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ গোপন জায়গা থেকে রুটিন মেনে হরতাল বা অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করছেন।

ঘোষিত কর্মসূচির আগের দিন সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তরা কয়েকটি যানবাহনে আগুন দেয়, এইটুকুতেই শেষ তাদের দায়িত্ব। হরতাল বা অবরোধ সফল করার জন্য ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে কিছু ঝটিকা মিছিলও হচ্ছে। তবে জনগণ তাদের এই কর্মসূচিতে সাড়া দিচ্ছে না।

গত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা হরতাল-অবরোধ মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ এখন আর জনজীবনে কোনো প্রভাব ফেলছে না। তাই বিএনপি সহিংসতার মাত্রা আরেক দফা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাসে আগুন দেয়ার পর এখন তারা ট্রেনে আগুন দেওয়ার কৌশল বেছে নিয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর ভোরে তেজগাঁও রেল স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দেওয়া আগুনে মারা গেছেন মা ও শিশুসহ চারজন। বাস ও ট্রেনে আগুন সন্ত্রাসের পর বিএনপি এখন বিএনপি অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা দিয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের সমালোচকরা বলছেন, বিএনপি আসলে একটি রিমোট নিয়ন্ত্রিত আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। লন্ডন থেকে কর্মসূচি আসে এবং ঢাকার গোপন জায়গা থেকে তা ঘোষণা করা হয়। তারা বলছেন, কল্পনা করুন তারেক রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারি কর্মচারীরা যদি সরকারের নির্দেশ না মানে এবং সরকার যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তারেক রহমান কি তাদের পাশে দাঁড়াবেন? কীভাবে দাঁড়াবেন? তিনি তো দেশেই নেই। রাজনীতি করবেন না বলে মুচলেখা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। আসলেই পুলিশ তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ান তামিল করবে। অসহযোগ আন্দোলন যেহেতু বড় কর্মসূচি তাই, লন্ডন থেকেই আসে প্রথমে এর ঘোষণা। পরে ঢাকার গোপন জায়গা থেকে রুহুল কবির রিজভী তার পুনরাবৃত্তি করেছেন।

এরমধ্যে অন্তত তিনটি মামলায় কারাদণ্ড হয়েছে তারেক রহমানের। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন। তারেক রহমান এখন পলাতক আসামি। তিনি লন্ডনে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপির রাজনীতি।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মেয়াদের ক্ষমতায় দল ও সরকারের মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল বেগম খালেদা জিয়ার হাতে। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত মেয়াদে মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল তার ছেলে তারেক রহমানের হাতে। হাওয়া ভবন ছিল ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র। বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে হরতাল-অবরোধের মাধ্যমেই আন্দোলন চলছিল। কিন্তু গত বুধবার দুপুর ১২টার দিকে ফেসবুক লাইভে তারেক রহমান ‘এই মুহূর্ত থেকে সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ’-এর ডাক দেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের সরকারের নির্দেশ না মানা, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন না করা, ভোটারদের কেন্দ্রে না যাওয়া, খাজনা-ট্যাক্স-ইউটিলিটি বিল না দেওয়া, ব্যাংকে টাকা না রাখা ও লেনদেন না করার নির্দেশ দিয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ যাতে আদালতে কোনো মামলায় হাজিরা না দেন। এই নির্দেশ মানতে গিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া সাংগঠনিক ও সরকারিভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হবে। তারেক রহমানের অসহযোগ ঘোষণার কিছুক্ষণ পর রুহুল কবির রিজভীও অসহযোগের ডাক দেন।

সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ে বিএনপি নানা কর্মসূচি ঘোষণা করতেই পারে। কিন্তু সেই কর্মসূচি হতে হবে বাস্তবতার নিরিখে এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে। এখনকার বাংলাদেশের যে মাঠের বাস্তবতা, তাতে বিএনপি একটা হরতাল সফল করতে পারে না, তাদের ডাকে মানুষ অসহযোগ করবে কোন ভরসায়। লন্ডনের নিরাপদ আশ্রয় থেকে তারেক রহমানের এই অসহযোগের ডাক বাংলাদেশের মানুষ, এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেও হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত