আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলি আইন

সিন্ডিকেট ভাঙতে সব উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে আসছে রদবদল

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রাজধানীসহ সারা দেশে অবস্থিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বছরে পর বছর এক দপ্তরে দায়িত্বে থাকায় আশপাশে সিন্ডিকেট বলয় গড়ে তোলেন। সেই বলয় সেবাপ্রত্যাশীদের হয়রানি ও জিম্মি করে অবৈধ বাণিজ্য করেন। এসব সিন্ডিকেট বা বলয় ভাঙতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পরই আন্তঃকর্তৃপক্ষে রদবদল আসছে।

জানা গেছে, এতদিন আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলি আইন না থাকায় রাজউক, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো যেসব কর্তৃপক্ষ রয়েছে, সেগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি কঠিন হয়ে পড়ছিল। এবার বদলির ইস্যুটি গুরুত্বসহকারে নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সেজন্য গত ১৩ নভেম্বর সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গেজেটে আন্তঃকর্তৃপক্ষ আইন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গেজেটে বলা হয়েছে- সরকার, জনস্বার্থে, কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কর্মচারীগণকে এক কর্তৃপক্ষ হইতে অন্য কর্তৃপক্ষে বদলি করতে পারবে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- এই ধারা ‘অন্যান্য কর্তৃপক্ষ’ অর্থ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং সময় সময় আইনের ধারা প্রতিষ্ঠিত অনুরূপ কোনো কর্তৃপক্ষ। ময়মনসিংহ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০২৩-এর খসড়া আইনেও আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলির ইস্যুটি রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি বিধিমালায় লঘুদণ্ড অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বর্ধন স্থগিত রাখা এবং সাত দিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা কর্তন করার সুযোগ রয়েছে। তবে গুরুদণ্ডের ক্ষেত্রে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে। এখানে আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলির ইস্যুতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এতে রাজউকসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষে কিছু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী যুগের পর যুগ এক দপ্তরে দায়িত্বে আছেন। তারা সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন, সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এক কর্তৃপক্ষ থেকে আরেক কর্তৃপক্ষে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির সুযোগ থাকলে দীর্ঘস্থায়ী সিন্ডিকেট তৈরি করা সম্ভব হয় না। বদলিতে সংস্থাগুলোয় অনিয়ম, দুর্নীতি কমবে। একইসঙ্গে সেবাপ্রত্যাশীরা সহজেই সেবা পাবেন।

সূত্রে জানা গেছে, রাজউকে ভবন মালিকদের বলছেন, নকশা বহির্ভূত ভবন ও পার্কিং নির্মিত হয়েছে। উৎকোচ না দিলে ভেঙে দেওয়া হবে। এ কথা শোনার পর অনেক বাড়ির মালিক উৎকোচ দিয়ে রক্ষা পাচ্ছেন। আবার যারা দিচ্ছেন না, তাদের ভবনের অবৈধ অংশ ভাঙা পড়ছে বা জরিমানা দিতে হচ্ছে। অনেক সময় জরিমানার টাকা নিয়েও দফারফা হচ্ছে। কারণ প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের বদলি সম্ভব হলেও রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি হয় না। আবার কাউকে বদলি করা হলেও তিনি রাজউকের এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে বদলি হচ্ছেন। এতে সিন্ডিকেট থাকছেই।

আন্তঃকর্তৃপক্ষ আইনের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, দিনে দিনে মানুষ নগরায়ণের দিকে ঝুঁকছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরের দিকে স্রোতের মতো মানুষ আসছে, এতে বাড়ছে জনঘনত্ব, বাড়ছে বহুতল ভবনের সংখ্যা। এসব বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক ও স্মার্ট নগরী প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সাতটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিত উন্নয়ন, ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা, যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ, পরিকল্পিত টেকসই স্থাপনাসমূহ নির্মাণ নিশ্চিতে কাজ করছে। কর্তৃপক্ষে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী একই দপ্তরে বছরের পর বছর চাকরি করছে, কারণ আইনগতভাবে তাদের বদলির সুযোগ নেই। এই সুযোগে তারা সিন্ডিকেট তৈরি করে। ওই সিন্ডিকেটের যোগসাজশে সেবাপ্রত্যাশীরা বিভিন্ন সময়ে ভোগান্তিতে পড়েন। সেজন্য সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনে আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলির ইস্যুটি রাখা হয়েছে। এখন যে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এক কর্তৃপক্ষ থেকে আরেক কর্তৃপক্ষে বদলি করা যাবে।

সচিব আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রাম হবে শহর’ ঘোষণা বাস্তবায়নে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর সাথে সাথে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য (এসডিজি) সমূহ অর্জন, ২০৪১ সালের মধ্যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চতকরণের কাজটিও সহজ হয়ে যাবে।

উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাজ হচ্ছে ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন দেওয়া। এছাড়া মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যার আলোকে একটি এলাকার সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন গেজেট প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর ও পায়রা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অপেক্ষায় আছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন এখন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) সাতটি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রয়েছে। বাকি পাঁচটি হচ্ছে কক্সবাজার, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এবং সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সরকার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ করেছে, সেগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না। রাজউকে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সিন্ডিকেট তৈরি করছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভবনের নক্শা অনুমোদন পেতে হয়। অথচ এসব কর্মকর্তা সরকারি বাড়ি, গাড়িসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু নাগরিকদের সেবা দিচ্ছে না। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ করে মানুষের কোনো উপকার হয় না। বরং সরকারের ব্যয় বাড়ে।

এদিকে সরকার গ্রাম ও শহরাঞ্চলে বিরাজমান গৃহায়ন সংকট নিরসনকল্পে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সব নাগরিকের জন্য গৃহায়ন ব্যবস্থা সহজলভ্য করছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলি আইন জরুরি ছিল। আগে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটের অভিযোগ উঠলেও অনত্রে বদলির সুযোগ ছিল না। সুতরাং নতুন আইনে কর্তৃপক্ষগুলো স্বাভাবিক নিয়মে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতে সহজেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি করতে পারবে।

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরও বলেন, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাড়ি চট্টগ্রামে, কিন্তু চাকরি করছেন ঢাকায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দপ্তরে। সেই চাকরিজীবী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বদলি পেতে আবেদন করেছেন, তখন আন্তঃকর্তৃপক্ষের নতুন আইনের মাধ্যমে সেই চাকরিজীবীদের বদলি করার সুযোগ থাকছে। এতে সব কর্তৃপক্ষের কাজের গতি বাড়ার পাশাপাশি সেবাপ্রত্যাশীদের হয়রানি কমবে বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই করতে পারেনি। চোখের সামনেই যত্রতত্র বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। আবার কেউ বহুতল ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন পেতে আবেদন করলে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। সেজন্য বাধ্য হয়েই অনেকে অনুমোদন ছাড়াই ভবন নির্মাণ করেছেন।

১৯৬১ সালে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে কেডিএ আইন পাস হয়। চার বছর পেরিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত জনবল নিয়োগ হয়নি। অনেকে ছাড়পত্র ছাড়া, আবার অনেকে অনুমোদিত নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণ করছেন। এসব অনিয়ম নজরদারির মতো জনবল তাদের নেই। খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, মানুষকে সেবা দিতে তারা জনবল চেয়েছেন। তবে এখনো পাননি। একই অবস্থা গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। ২০২০ সালে গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যাত্রা শুরু হয়। ১ হাজার ৪০০ জনবল নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জনবল সংকটে তাদের অনুমতি ছাড়াই নতুন নতুন ভবন গড়ে উঠছে। কর্মকর্তারা বলছেন, শহরের সুশৃঙ্খল আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে, যার ওপর ভিত্তি করে আবাসিক-বাণিজ্যিক এলাকা চিহ্নিত হয়। খেলার মাঠ, জলাধার, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে মহাপরিকল্পনা থাকবে।

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলছেন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ করে মানুষের কোনো উপকার হয় না। বরং সরকারের ব্যয় বাড়ে। কারণ মানুষ কর্তৃপক্ষের কাছে সেবা নিতে গিয়ে উল্টো ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। নিয়মণ্ডনীতির বেড়াঝালে আটকিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ঘুষ নিচ্ছে। তবে আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলি কার্যকর থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারী সহজে সিন্ডিকেট তৈরি করতে পারবেন না। এক কর্তৃপক্ষ থেকে আরেক কর্তৃপক্ষে বদলি হওয়ার পর সিন্ডিকেট তৈরি করতে করতেই দেখবেন বদলির সময় হয়েছে। সুতরাং আন্তঃকর্তৃপক্ষ বদলি আইন করলেই হবে না, তা বাস্তবে কার্যকর করতে হবে।