বিএনপির নেতারাই মানছে না অসহযোগ আন্দোলন

হরতাল-অবরোধের মতো এ কর্মসূচিও ব্যর্থ!

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

সরকার পতনের লক্ষ্যে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত ২০ ডিসেম্বর ‘অসহযোগ আন্দোলনের’ ডাক দেয় বিএনপি। তবে তাতে দৃশ্যমান কোনো সাড়া মেলেনি। বিএনপির পক্ষ থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেসব ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে, তার কোনোটিতেই প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির নেতারাই মানছে না অসহযোগ আন্দোলন। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, তাদের মূল লক্ষ্য ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানো ও বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো। তাদের দাবি ভোটগ্রহণের নির্ধারিত দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অসহযোগসহ সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রভাব স্পষ্ট হবে। গত ২০ ডিসেম্বর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তার ঘোষণা অনুযায়ী, অসহযোগের ক্ষেত্রগুলো হলো- ৭ জানুয়ারি ভোট বর্জন, ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচনি দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকা, সেবামূলক কর ও খাজনা পরিশোধ বন্ধ রাখা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ ইউটিলিটি বিল না দেওয়া, ব্যাংকে অর্থ আমানত না রাখা এবং বিভিন্ন মামলায় আসামি হওয়া নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা না দেওয়া। তবে এসব আহ্বানে কার্যত কোনো সাড়া মিলছে না।

জানামতে, অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা না দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এ নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কেউ কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ হাজিরা দেওয়া নিয়ে ‘দ্বিধাদ্বন্দ্বে’ ভুগছেন। ঢাকার নিম্ন আদালত ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েও বিএনপির অনেক নেতাকর্মী আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। আবার অনেকে আদালতে উপস্থিত না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সময়ের আবেদন করেছেন। বিএনপিপন্থি সিনিয়র আইনজীবীরা অসহযোগ আন্দোলন সমর্থনে বিরত থাকলেও নিজেদের জুনিয়র আইনজীবী দিয়ে হাজিরা দিচ্ছেন।

হাজিরা দিতে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির নানা আন্দোলনে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে হামলা, মামলার শিকার হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন। এখনো সব কর্মসূচি বাস্তবায়নে দলের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন তারা। একাধিক মামলায় তারা আসামি হওয়ায় নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে যান। হাজিরা না দিলে জামিন বাতিল এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে পারে- এমন শঙ্কাও রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে হাজিরা না দেওয়ার নির্দেশনা মানবেন, নাকি হাজিরা দিয়ে জামিনে থাকবেন, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন তারা। তবে কেউ কেউ আইনজীবীদের পরামর্শে আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন হলে তারা হাজিরা দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান।

জানা গেছে, সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা না দেওয়া কিংবা ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল স্থগিত করার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তাতে দলের ভেতরে অনেককে বিস্মিত হয়েছেন। হঠাৎ করে সরাসরি অসহযোগের মতো কর্মসূচি ঘোষণাটি ‘সময় আসার আগেই’ হয়ে গেছে কি না- তা নিয়ে দলটির ভেতরে বাইরে নানা আলোচনা হচ্ছে।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক নেতা জানান, সাধারণত সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি যাদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হয় অসহযোগ কর্মসূচির ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। কারণ, আন্দোলনে সমর্থন থাকলেও সাড়া দেওয়ার কৌশল জানা নেই তাদের। আবার ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে এ আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন না।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিএনপি আকস্মিক এ ধরনের আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এক্ষেত্রে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো কঠিন হবে। তাই হরতাল-অবরোধের মতো এ কর্মসূচিও ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যদিও অসহযোগ আন্দোলনকে জনগণের পরোক্ষ প্রতিরোধ হিসেবে দেখছে বিএনপি। তাই তাদের সংযুক্ত করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে বলে মনে করছেন না তারা। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, জনগণের পক্ষের যেকোনো আন্দোলন সফল হবেই। সরকারের নিপীড়ন থাকবে, হয়রানি করবে, গ্রেপ্তার করবে। তারপরও আন্দোলনের সফলতা আসবেই। তবে এ লড়াই দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে গণসংযোগ শুরু করা হয়েছে। লিফলেট বিতরণ চলছে। এসব লিফলেটে বিএনপির আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা হচ্ছে। রুহুল কবির রিজভীর দাবি, তারা তাদের আন্দোলনের বিষয়বস্তু বিভিন্ন সময় জনগণের কাছে তুলে ধরেছেন এবং সেগুলো থেকে সাড়াও পেয়েছেন। আর এই আন্দোলনেও তারা সাড়া পাবেন। অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে গণমাধ্যমভিত্তিক যেসব প্রযুক্তি আছে সেগুলো ব্যবহার করেও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হবে।

এদিকে রাজনৈতিক মামলায় নেতাকর্মীদের হাজিরা না দেওয়ার জন্য বিএনপি হাইকমান্ড থেকে নেতাকর্মীদের যে আহ্বান জানানো হয়েছে তাতে সাড়া না দেওয়ার ব্যাপারে অনেকেই শক্ত যুক্তি উপস্থাপন করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক নেতা বলেন, মামলায় হাজিরা না দিলে এক-দুই তারিখ পর জামিন বাতিল করা হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে আদালত থেকে ওয়ারেন্ট জারি করা হবে।

এ সময় গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের আত্মগোপনে থাকতে হবে অথবা গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যেতে হবে। আত্মগোপনে থাকলে তাদের অনুপস্থিতিতে আদালত বিচারিক কার্যক্রম শুরু করবে। এতে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওই নেতার ভাষ্য, অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মী দীর্ঘদিন ধরে ঘরছাড়া। তাদের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। এ ফাঁদে পড়ে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী চাকরি খুঁইয়েছেন। অথচ এ সময় দলের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। নেতারা কেউ তাদের খোঁজ নেননি। তাই মামলায় হাজিরা না দিয়ে নতুন করে বিপদ ঘাড়ে নিতে চান না অধিকাংশ কর্মী। তবে কোর্টে হাজিরা বা মামলার কাজে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির অনেকেই একমত। তাদের দাবি দুই মাসে যে হারে নেতাকর্মীদের আটক ও সাজা দেওয়া হয়েছে, তা মোকাবিলার শক্তি বিএনপির নেতাকর্মীদের নেই। জামিন নিয়ে বের হলেও বারবার আটক করা হচ্ছে। তাছাড়া আটক এড়াতে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তাই কোর্টে না গিয়ে এ ব্যবস্থাকে অনাস্থা জানালে তার ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তারা।

এ প্রসঙ্গ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, অসহযোগ মানেই সরকারকে সহযোগিতা না করা। এই সময়ে কেন আমরা অসহযোগ দিলাম তার যুক্তিযুক্ত কারণ অবশ্যই আছে। এই সরকারকে দেশের অনেক মানুষ পছন্দ করছে না। আমাদের অসহযোগ কর্মসূচির সফলতা আসবে বলে মনে করছি।

এদিকে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবু আব্দুল্লাহ বলেছেন, আমরা দেখছি বিএনপির হাইকমান্ড যে ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে তা নেতাকর্মীরা মানছে না। তারা আদালতে এসে হাজিরা দিচ্ছেন। বিএনপির আইনজীবীরাও আদালত করছেন। আমি আগেও বলেছি আসামিদের হাজিরা দিতে নিষেধ করার সিদ্ধান্ত হটকারি। এর ফলে ওই আসামিরা পলাতক হয়ে যাবেন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে। এতে বিএনপির নেতাকর্মীরাই আইনিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বিএনপির অসহযোগ ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, ‘তাদের (বিএনপি নেতাকর্মীদের) বাসায় বিদ্যুৎ-গ্যাস বন্ধ হয়ে গেলে তারা কী করবে? যেহেতু অসহযোগ ওনারাই চাচ্ছেন, বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাবে, পানি বন্ধ হয়ে যাবে, সরকার অচল হয়ে যাবে; তাহলে কী হবে? তারা কি সেটা বুঝতে পারছেন যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল না দিলে ওয়াসা এবং বিদ্যুৎ বিভাগ অন্য গ্রাহকের জন্য যা করে তাদের জন্যও তাই করবে; তাহলে কী হবে? সেটা নিয়েও তাদের চিন্তা করা উচিত।’