ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নতুন বছরে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা

* গ্রাহক চাহিদা মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ * কমছে ডিজেলের মজুত * সেচ মৌসুমে চাহিদা ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট * সাড়ে ১৮ লাখ টন জ্বালানি কিনবে সরকার
নতুন বছরে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা

নতুন বছরের শুরুতেই জ্বালানি খাতে ধাক্কা সামলিয়ে শিল্প-কারাখানার কাজের গতি বাড়ানোর চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে সরকার। জ্বালানির বাড়তি চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব না হলে, পণ্যসামগ্রীর দাম আরো বাড়বে।

তবে এসব শঙ্কা সামলাতে নতুন বছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি) ভিত্তিতে সাড়ে ১৮ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

জানা গেছে, গ্যাস, কয়লা ও অপরিশোধিত তেলের পর এবার ডিজেলের দামও বাড়তে পারে বলে আভাস এসেছে। জ্বালানির সংকট নিরসনে গত বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় সাড়ে ১৮ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আগামী সেচে মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে বিদ্যুৎ ভবনে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বলা হয়েছে, গত সেচ মৌসুমে গ্রীষ্মের বাড়তি চাহিদা মিলে এপ্রিলে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এবার সব মিলে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট হতে পারে।

অর্থাৎ, গত বছরের সেচ মৌসুমের তুলনায় ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সব ধরনের জ্বালানি মজুতের কথা বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। চাহিদা অনুসারে ফার্নেস ও ডিজেল সরবরাহ করা যাবে বলে জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তাই গ্যাস, ফার্নেস তেল ও ডিজেলের সরবরাহ বাড়ানো প্রয়োজন। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি তেলের মজুত রাখতে হবে। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন ১৫৪ থেকে ১৭৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস, ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫০ টন ফার্নেস, ১৫ হাজার ৬০০ টন ডিজেলের চাহিদা হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেরাই ফার্নেস তেল আমদানি করে। তাদের বিল বকেয়া ও ঋণপত্র খোলার জটিলতা আছে। তাই সব মিলিয়ে জ্বালানির সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা আছে।

জ্বালানি খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছে পণ্যসামগ্রী। এ ব্যাপারে বিশ্লেষকরা বলেছেন, সদ্য বিদায়ি বছরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী মানুষের লাগালের কাছে রাখার অব্যাহত প্রচেষ্টার মধ্যেও খাদ্য, পোশাক ও প্রসাধনী পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ায় দেশেও দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল। নতুন বছরেও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। রাশিয়া ও সৌদি আরব যদি উৎপাদন হ্রাস অব্যাহত রাখে তাহলে এ বছরে জ্বালানি তেলের দাম তিন অঙ্কের ঘরে যাবে। এমন পূর্বাভাস দিয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করেছে বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস। সংস্থার মতে, এ বছরে ব্রেন্ট অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১০৭ ডলারে উঠতে পারে। এরই মধ্যে ব্রেন্ট তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

গোল্ডম্যান স্যাকস বলেছে, ওপেক প্লাস ২০২৩ সালে তেল উৎপাদন হ্রাসের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি যদি ২০২৪ সালেও কার্যকর থাকে তবে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০৭ ডলারে উঠতে পারে।

বিপিসি সূত্র জানায়, বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপিসি ৪৩ হাজার থেকে ৪৩ হাজার ৫০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। গত তিন মাসে প্রায় ১৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করছে, যার পুরোটাই সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আমদানি করা হয়। একই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হচ্ছে না। ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট লোডে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে, যেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। এদিকে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৮ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। কিন্তু সেখানে উৎপাদন করা হচ্ছে ৪ হাজার মেগাওয়াট।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ পূর্বাভাস দিচ্ছেন, জ্বালানি তেলের সরবরাহ ক্রমান্বয়ে টানটান হবে। মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে হচ্ছে। সেই সময়ে ডিজেলের সংকট বাড়লে তা বাজারে আরো বেশি চাপ তৈরি করবে। কারণ বছরজুড়েই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ডলার সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে।

ডলার সংকটের জেরে ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি না খোলায় বিপিসির সংকট বেড়ে যায়। সময়মতো এলসি খোলা এবং তেল সরবরাহকারীদের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে না পারার কারণে নির্ধারিত সময়ে তেল সরবরাহ অনেক ক্ষেত্রে বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে কঙ্কিত তেলের রিজার্ভ কমেছে। কমে আসছে ডিজেলের মজুতও।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, বিপিসির কাছে তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো ২৪৭ মিলিয়ন ডলার পাওনা হয়েছে। ডলার সংকট কাটাতে বিপিসি দফায় দফায় জ্বালানি বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করলেও প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ বাড়েনি। ফলে নানা কৌশলে বিপিসি জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে। এদিকে ডলার সংকটের কারণে দিন দিন তেল সরবরাহকারীদের পাওনার পরিমাণ বাড়ছে। এমতাবস্থায় কিছু কোম্পানি তেল সরবরাহে অনীহাও প্রকাশ করেছে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, চলতি ডিসেম্বরে ১০টি তেলের জাহাজ পাঠানোর কথা ছিল সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর। এগুলোর মধ্যে পাঁচটি জাহাজই পেমেন্ট জটিলতায় বিলম্বে সরবরাহ করা হয়েছে। দেশের বেশ কয়েকটি ডিপোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তেলের রিজার্ভ আছে। তবে কিছুটা কম। বিশেষ করে ডিজেলের রিজার্ভ কমেছে।

মেঘনা অয়েল কোম্পানির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, এখন তেলের সংকট নেই, রিজার্ভ কমেছে। নতুন তেল ডিপোতে ঢুকলে স্বাভাবিক হবে। সঠিক সময়ে নিশ্চয় জ্বালানি তেলের পর্যাপ্ত আমদানি ও সরবরাহের ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে করবে।

ডলার সংকটে জ্বালানি আমদানিতে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধে জরিমানা দিতে হচ্ছে। সেজন্য বিপিসি ১১ ডিসেম্বর জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘ বকেয়ার কারণে বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল বিলম্বে সরবরাহ বা বাতিলের প্রস্তাব করছে। বারবার অনুরোধ করলেও তারা রাজি হচ্ছে না। এভাবে চললে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ডিজেল ও জেট ফুয়েলের মজুত প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসবে। ফলে জ্বালানি তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, দেশে এক মাসের মজুত রাখা হয় জ্বালানি তেলের। গত ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ডিজেলের মজুত সক্ষমতা ৬ লাখ টন, মজুত আছে ১ লাখ ৭০ হাজার টন। এ মজুত দিয়ে ১৪ থেকে ১৫ দিনের চাহিদা মেটানো যাবে। জেট ফুয়েলের মজুত সক্ষমতা ৬৫ হাজার ৮৩৮ টন, মজুত আছে ৯ হাজার ৬৮৫ টন। এটি দিয়ে আরো চার দিন চালানো যেতে পারে।

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, জেট ফুয়েল শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বর্তমান মজুত ফুরানোর আগেই নতুন তেল ডিপোতে যুক্ত হবে। দুটি জাহাজে নতুন করে ৩১ হাজার টন জেট ফুয়েল আসছে। ডিজেলেরও মজুত আছে, আরো আসছে। জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, জ্বালানি খাতে বিল বকেয়া রাখলে সরবরাহকারীরা সমস্যা তৈরি করবে। এভাবে চললে জ্বালানি সরবরাহকারীদের কেউ কেউ বাংলাদেশের সঙ্গে তেল সরবরাহের ব্যবসা বন্ধ করবে। তাই অগ্রাধিকার দিয়ে জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে ডলার সরবরাহ করা উচিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত