ভোটার উপস্থিতি মূল টার্গেট
নির্বাচনের দিকে চোখ বিশ্বের
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক আলম
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ। দেশব্যাপী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে শেষ মুহূর্তের বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন প্রার্থীরা। কারণ, এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখ এখন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। এই নির্বাচন গভীর পর্যবেক্ষণে রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হোক। প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও একই প্রত্যাশা। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার গত বুধবার ব্রিফিংয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থন করে। আমরা নিবিড়ভাবে এ নির্বাচনের দিকে নজর রাখছি। জাতিসংঘও বাংলাদেশের নির্বাচন গভীর পর্যবেক্ষণে রাখার কথা বলেছে। গত বুধবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সহযোগী মুখপাত্র ফ্লোরেন্সিয়া সোতো নিনো বলেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের আশা, স্বচ্ছ ও সংগঠিত উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন পর্যন্ত এতটুকুই আমাদের বলার আছে।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। ভোটের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে, এমন একটি সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলেছে নির্বাচন কমিশন।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ না করায়, ক্ষমতাসীন দলের অনেকে নেতাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হোক- এমন প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্রের এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও একই প্রত্যাশা। সেই লক্ষ্যে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার উপস্থিতি দেখাতে চায়। এজন্য প্রত্যেকটি মহল্লা, ইউনিয়ন, থানা ও জেলা শহরে দলটির নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনি কমিটি করেছে। এসব কর্মী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে সহযোগিতা করবে। পাশাপাশি কিছু কর্মকৌশলও আছে। তবে বিএনপির হরতাল ও ভোট বর্জন কর্মসূচির মুখে শেষ পর্যন্ত ভোটের হার বাড়ানোর লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
আজ সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হবে, চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ বেশ কিছু দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা জনগণকে ভোট দিতে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ১০ দিন ধরে সারা দেশে গণসংযোগ কর্মসূচি চালিয়েছে।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। সে নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ে বলে জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ নিবন্ধিত সব দল অংশ নিলেও এ নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক ছিল। সেবার ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছিল বলে জানায় ইসি। এর আগে ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম ও ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নির্বাচনগুলোতে সারা দেশে মোট ভোটারের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের সমর্থন পেয়েছিল বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৮ থেকে ৪১ শতাংশ। সে হিসাবে বিএনপির অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোটার আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সাধারণ ভোটারদের অনেকে এবার ভোটে আগ্রহী না-ও হতে পারেন।
এবার ৩০০ আসনের মধ্যে ১৩০টির মতো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হতে পারে। এই আসনগুলোতে ভোট পড়ার হার ভালো হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। তবে যেখানে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই সেখানে সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা কঠিন। আর বড় শহরগুলোতে অতীতেও বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটারদের অনীহা দেখা গেছে। ২০২০ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। ওই নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোট পড়ার হার ছিল ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শক্তিশালী বিরোধি দলের অনুপস্থিতিতে ফুরফুরে অনেক প্রার্থী। কারণ, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে থাকে আওয়ামী লীগ। এমনকি দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। এবার তা হয়নি। বরং দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত এবং এই কৌশলের বাইরে ক্ষমতাসীনরা ভোটার বাড়াতে আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি কাজ করবে। কেন্দ্রে ভোটার আনতে প্রশিক্ষণ দিয়ে কয়েক লাখ কর্মী তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ। এর বাইরে গত সেপ্টেম্বরে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে সারা দেশের জন্য ১২টি দল গঠন করা হয়। প্রতিটি দল গড়ে পাঁচ থেকে সাতটি সাংগঠনিক জেলার দায়িত্ব পায়। এসব জেলা থেকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের থেকে বাছাই করে প্রচারকর্মীর তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর তাদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন পুলিশ সদস্যরা। ভোটারদের ভোট দিতে কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশনও ভোটারদের উৎসাহিত করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন প্রচার চালাচ্ছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন বলেছে, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো তাদের কাজ নয়।
নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, এবার কিছু দল নির্বাচন বর্জন করেছে, তাই ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি অবশ্যই কিছুটা চ্যালেঞ্জের। ভোটারদের উপস্থিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়। আমাদের দায়িত্ব সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে, নির্দ্বিধায় ও নিরাপত্তার সঙ্গে ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন। সেই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। চীন আশা করছে নির্বাচন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচনের পর বাংলাদেশ হবে আরো শক্তিশালী, সহনশীল ও ঐক্যবদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দল নেই। তাই অংশগ্রণমূলক হচ্ছে না- এটা তো স্পষ্ট। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো অনেক দেশ যে নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে সেটা কেমন হয় তা তারা দেখতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ নতুন কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, তার একটি প্যারামিটার হবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন।
তিনি আরো বলেন, সব দেশই তার দেশের স্বার্থ আগে দেখে। আমাদের এখানে রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগে তারা স্বার্থ আদায় করতে চায়। ভারত তার স্বার্থেই কথা বলছে।