রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লেগে দগ্ধ আট রোগী শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে তাই কেউ এখনো ঝুঁকিমুক্ত নন।
গতকাল শনিবার বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান। সামন্ত লাল সেন বলেন, আমাদের এখানে ভর্তি আছে আটজন। বার্নের পার্সেন্টেজ বেশি না, কারো ৯ পার্সেন্ট, ৮ পার্সেন্ট। অনেকের বাইরে কোনো বার্নই হয়নি। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, তাদের সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। আমরা দেখতে পেলাম, তাদের অনেকের ভেতরে অসুবিধা আছে, ম্যানেজ করতে সময় লাগবে। এর আগে গত শুক্রবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। পরে আটটি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১০টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। দুর্বৃত্তদের দেওয়া এ আগুনে চারজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শুক্রবার রাতে গোপীবাগে ঢাকাগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস যাত্রীবাহী ট্রেনের চারটি বগিতে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিঞ্জপ্তিতে বলা হয়, আগুনের ঘটনা নাশকতামূলক কাজ কি না, তা উদ্ঘাটন করতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা আহতদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। শোক বার্তায় তিনি নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি আহত ব্যক্তিদের আশু আরোগ্য কামনা করেন।
সূত্র মতে, সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে ট্রেনগুলো যথাসময়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে গেছে। তবে ঢাকাগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস (৭৯৫) ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ট্রেন যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর ফলে যাত্রীর সংখ্যা কিছুটা কম দেখা গেছে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে। বিষয়টি ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, অন্যান্য দিনের মতো সকাল থেকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক আছে। ট্রেনগুলো যথাসময়ে স্টেশন ছেড়ে গেছে। গত শুক্রবার রাতের ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক দেখা গেছে। যাত্রীর সংখ্যাও কম দেখা গেছে স্টেশনে।
এদিকে, রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া ছেলেকে খুঁজতে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছেন তার বাবা আবদুল হক। গত শুক্রবার ফরিদপুর থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে যাত্রা করেন ছেলে আবু তালহা। গতকাল শনিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ মর্গে ছেলের খোঁজে আসেন আবদুল হক। এছাড়া আরো কয়েকজন তাদের আপনজনের খোঁজে ঢামেকের মর্গে আসেন।
এদিকে, রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগের মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থ ও ইন্ধনদাতা হিসেবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ নবী উল্লাহ নবীকে চিহ্নিত করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য নবীর সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতকে এ তথ্য জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের এসআই আশরাফুল আলম। গতকাল শনিবার নবীকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে ডিবি। অন্যদিকে নবীর আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিলা সুমু আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠান।
বিএনপি ও সমমনাদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল শুরুর আগের রাতে শুক্রবার দিবাগত রাত ৯টার দিকে রাজধানীর গোপীবাগে যশোরের বেনাপোল থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে চলন্ত অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়। আগুনে দুই নারী, এক শিশুসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের কারো কারো অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, নবী বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থদাতা ও ইন্ধনদাতা। অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে জড়িত অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের সঠিক নাম-ঠিকানা শনাক্তপূর্বক গ্রেপ্তার, অর্থের জোগনদাতা ও ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য নবীকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন।
আবেদনে বলা হয়েছে, মামলার এজহারনামীয় আসামি নবী উল্লাহ নবী ৫ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থানাধীন যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে ধোলাইপাড়গামী রাস্তার সড়কে বিজিবি মার্কেটের সামনে পাকা রাস্তার ওপর বেআইনিভাবে দলবল নিয়ে দেশীয় অস্ত্র-শন্ত্র, ইট পাটকেল, বাঁশের লাঠি ও ককটেলসহ অবস্থান নেন। তারা সরকারবিরোধী উসকানিমূলক ও অবমাননাকর স্লোগান দিতে থাকেন। সড়কে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে চরম জনভোগান্তি তৈরি হয়।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে ট্রেনটির তিনটি বগি পুরোপুরি পুড়ে যায়। পরে একটি বগি থেকে মা ও শিশুসহ চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
পুড়ে অঙ্গার মরদেহগুলো চিনতে পারছেন না স্বজনরা : রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনের ঘটনায় নিহত চারজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে আনা হয়েছে। পুড়ে অঙ্গার হওয়া এসব মরদেহ এখন চেনার উপায় নেই। এজন্য ডিএনএ পরীক্ষার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে স্বজনদের। গতকাল শনিবার সকাল থেকে মর্গের সামনে ভিড় জমান স্বজনরা। পুলিশ তাদের লিখিত আবেদন জমা নিচ্ছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সেতাফুর রহমান বলেন, এখানে চারটি মরদেহ আছে। এখন পর্যন্ত চারজন তাদের স্বজনর সন্ধান চেয়ে আমাদের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। এছাড়া একজন মৌখিকভাবে বলেছেন দেখতে।
সেতাফুর রহমান জানান, ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া মরদেহগুলোর পরিচয় শনাক্ত করা যাবে না। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে স্বজনদের।
এলিনা ইয়াসমিনের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীতে। স্বামী সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন এবং পাঁচ মাসের ছেলে সন্তান আরফানকে নিয়ে থাকতেন মিরপুরের ৬০ ফিট রোড এলাকায়। ১০ দিন আগে মারা যান এলিনার বাবা। বাবাকে চিরবিদায় জানাতে শিশু সন্তানকে নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন গতকাল বেনাপোল এক্সপ্রেসে করে। ট্রেনে আগুন লাগার পর থেকে খোঁজ নেই এলিনা ইয়াসমিনের। তার খোঁজে মর্গের সামনে এসেছেন ফুফা নজরুল ইসলাম এবং চাচাতো ভাই সোহেল রানা।
নজরুল ইসলাম বলেন, ট্রেনে করে আমাদের পরিবারের মোট ৬ জন সদস্য ঢাকায় আসছিলেন। এর মধ্যে এলিনা ইয়াসমিনের ৬ মাসের বাচ্চা আরফানও ছিল। এলিনা ছাড়া সবাই বেঁচে ফিরলেও এখনো তার খোঁজ পাচ্ছি না আমরা। এ বিষয়ে আমরা রেলওয়ে পুলিশকে জানিয়েছি। এলিনার চাচাতো ভাই সোহেল রানা জানান, এলিনার একটা সমস্যা ছিল। সে অল্পতেই ঘাবড়ে যেত। হতে পারে এজন্যই অন্যরা নেমে যেতে পারলেও এলিনা পারেনি।