দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে পরে নানা নাটকীয়তায় জাপা

কিছু দিন সময় চেয়ে স্পিকারের কাছে চিঠি

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে নানা নাটকীয়তায় জড়িয়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। ভোটের আগে দলের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং ভোটে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত ভোটে অংশগ্রহণ করে দলটি। এখন ভোট শেষ হওয়ার পর শপথগ্রহণ নিয়ে নাটক শুরু করেছে জাপা।

গতকাল নবনির্বাচিত দলীয় সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের জন্য আরো কিছু দিন সময় চেয়ে স্পিকারের কাছে চিঠি দিয়েছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সেলিম ওসমান বলেন, শপথে অংশ নেবে জাতীয় পার্টি। কিন্তু গতকাল গেজেট হওয়ায় আমাদের দলের পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়েছে। গেজেট অনুযায়ী আজ শপথ। আমাদের বিজয়ী প্রার্থীরা সবাই এক জায়গায় আসতে সময় লাগছে। সে কারণে সময় চাওয়া হয়েছে। শপথ না নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

সেলিম ওসমান আরো বলেন, আমাদের সদস্যদের কেউ ওমরার নিয়ত করেছেন, কেউ হয়তো অন্য কোনো কাজে। তাই আমাদের দলের পক্ষ থেকে সকালে স্পিকারকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।

আজ জাতীয় সংসদের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে। গতকাল গেজেট প্রকাশ হয়েছে। গত রোববার সারা দেশে একযোগে ২৯৯ আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৯৮টি আসনের ফল বেসরকারিভাবে ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২ আসনে জয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠা পেয়েছে। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১১ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে জয়ী হয়েছেন।

এক প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে স্থগিত হওয়া নওগাঁ-২ (পত্নীতলা ও ধামইরহাট) আসনে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ময়মনসিংহ-৩ আসনের একটি কেন্দ্রে অনিয়ম হওয়ায় ফলাফল ঘোষণা স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। এই ছাড়ের পরও ১১টি আসনে বিজয়ী হন দলটির প্রার্থীরা।

বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী (ফেনী-৩), হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (ঠাকুরগাঁও-৩), গোলাম কিবরিয়া (বরিশাল-৩), একেএম সেলিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫), মো. আশরাফুজ্জামান (সাতক্ষীরা-২), একেএম মোস্তাফিজুর রহমান (কুড়িগ্রাম-১) ও শরিফুল ইসলাম (বগুড়া-২) নির্বাচিত হয়েছেন। একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা (সংরক্ষিত নারী আসন বাদে) ছিল ২৩টি। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনের তিন দিনের মধ্যে শপথ নিতে হবে বিজয়ীদের। তবে ৯০ দিনের মধ্যে শপথ না নিলে তাদের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়।

জাতীয় পার্টির একাধিক নেতার ভাষ্য, জাতীয় পার্টি শপথের জন্য সময় চাওয়ার পেছনে ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ হওয়ার বিষয়টি যুক্ত।

গত দুটি সংসদ নির্বাচনে ২০টির বেশি করে আসনে জয়ী হয়ে জাতীয় পার্টি টানা দুইবার বিরোধীদলের ভূমিকায় থাকলেও এবার দলটির আসন অর্ধেকে নেমে এসেছে। জাতীয় পার্টি একাদশে আসন পেয়েছিল ২৩টি। কিন্তু এবার পেয়েছে ১১টি। অপরদিকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে এবার ৬২ জন জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার রেকর্ড হয়েছে। এর আগে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন।

এবার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংখ্যার দিক সংসদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনপ্রাপ্ত দলের চেয়ে বেশি হওয়ায় তারা সমষ্টিগতভাবে বিরোধীদল হিসেবে সংসদে ভূমিকা পালন করতে পারবে কি না সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।

জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ অংশের একজন প্রভাবশালী নেতা মনে করছেন, জাতীয় পার্টি শপথের জন্য সময় চাওয়ার মানে হলো, বিরোধীদল হিসেবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব ও জিএম কাদেরের বিরোধীদলীয় নেতা হওয়াটা নিশ্চিত করার কৌশল। দর কষাকষি করার জন্য জাতীয় পার্টি কয়েক দিন ঝুলে থাকবে বলে দাবি করেন এই নেতা।

জাতীয় পার্টির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১১টি আসন পেয়েছে। তবে নির্বাচিত এমপিরা আজ শপথ নাও নিতে পারে। পরশু আমরা সিদ্ধান্ত নেব বসে। তারপর সিদ্ধান্ত হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বরাবরের তো জাতীয় পার্টি (জাপা) ছিল আলোচনায়। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্যে জাপার নির্বাচনে আসা না আসা নিয়েও ছিল দোলাচল। জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের অনেক নাটকীয়তার পর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে আসে দলটি। সেই সমঝোতার ২৬ আসনের মধ্যে মাত্র ১১টিতে জয় পেয়েছে।

অনেক নাটকীয়তা, দেনদরবারের পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পেয়েছিল জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)। সব মিলে এবার ২৬৫টি আসনে দলটির প্রার্থী ছিল। শেষ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া ২৬ আসনের ১১টিতে জিততে পেরেছেন জাপার প্রার্থীরা। সমঝোতার বাইরে কোনো আসনে দলের প্রার্থী জিততে পারেননি।

ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কমল। বর্তমানে দলটির ২৩ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছেন। আর সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য রয়েছেন চারজন।

২০১৪ ও ২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে জাপা নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাপাকে ৩৩টি আসন দেওয়া হয়েছিল। সেবার তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে মন্ত্রিসভায় থাকে, আবার বিরোধীদলেরও ভূমিকা পালন করে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে জাপা ২৩টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধীদল হয়। এবার দলটি গতবারের অর্ধেকের কম আসন পেল। এবার জাপা তাদের এযাবৎকালের সর্বোচ্চ ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এর মধ্যে ১১ জন প্রার্থী নিজে থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাইয়ের পর ২৬৫ জন প্রার্থী টিকে থাকেন। তবে নির্বাচনি প্রচার শুরুর পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ১৯ জন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত ভোটে ছিলেন ২৪৬ জন। যদিও তাদের অনেকেই প্রচারে তেমন একটা ছিলেন না